লিখেছেনঃ আতিকুর রহমান
বর্তমান সমাজে আত্মীয়তার বন্ধন দিন দিন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়তার বন্ধনের পূর্বের সোনালী দিনগুলো এখন আর নেই। অথচ ইসলাম আত্মীয়তার বন্ধনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। এ সম্পর্কে চমৎকার দু’টো আর্টিক্যালটি পেলাম। সামান্য এডিট করে শেয়ার করছি। নিজেকে দিয়ে বিচার করে আশা করছি অপররাও এ লেখা থেকে উপকৃত হবেন, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা আমাকে সহ অপর সকলকে আত্মীয়তার হক আদায় ও এর বন্ধনকে সুদৃঢ় করার তৌফিক দান করুক, আ-মীন।
আত্মীয় বলতে আমরা বুঝি আপন লোকজনকে। এক বংশ ও রক্ত যার শরীরে বহমান তিনিই রক্ত সম্পর্কের আপনজন। আবার বৈবাহিক কারণেও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় একটি বিধান। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গোনাহ যা তওবা ব্যতীত মাফ হয়না। আর কবিরা গোনাহ-পরবর্তী তওবা না করে মৃত্যুবরণ করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীর জন্য আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে যেমন রয়েছে পুরস্কার, তেমনই এ সম্পর্ক ছিন্নকারীর জন্য রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি।
আল্লাহ তা’আলার অভিশাপ প্রাপ্ত
ইসলাম আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর প্রতি কঠিন শাস্তি ও আজাবের কথা ঘোষণা করেছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীরা আল্লাহ তা’আলার অভিশাপপ্রাপ্ত। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘যারা আল্লাহর (ইবাদত করার) দেওয়া প্রতিশ্রুতির পর তা লঙ্ঘন করে, আর (আত্মীয়তার) সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।’ (সূরা আর রাদ: ২৫)
নেক আমলসমূহ কবুল হবে না
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর নেক আমল আল্লাহ তা’আলা কবুল করেন না। আদম সন্তানের আমল সপ্তাহে একদিন আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর আমলগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের আমল (সপ্তাহের) প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুমার রাতে আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কোনো আমল কবুল করা হয় না।’ (আহমাদ: ২/৪৮৪)
জান্নাতে প্রবেশ করবে না
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কঠোর শাস্তি সম্পর্কে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিসে বর্ণনা এসেছে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে মহানবী ঘোষণা দিয়েছেন। হজরত যুবাইর ইবনে মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’(সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি পাবে
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর শাস্তি শুধু আখেরাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জগতেই শাস্তি পেতে হবে। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়াতে যে (দুই) অপরাধের শাস্তি আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত দ্রুত কার্যকর করে থাকেন এবং আখেরাতেও এর শাস্তি অব্যাহত থাকবে, সে দু’টি অপরাধ হলো- ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। (জামে তিরমিজি)
আল্লাহ তা’আলা সম্পর্ক ছিন্ন করবেন
কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে আল্লাহ তা’আলাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আমি রহমান। আমি আত্মীয়তার জন্য আমার নাম থেকে একটি নাম বাছাই করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’ (সুনানে আবু দাউদ)
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম এক কারণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীতার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহ তা’আলা অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন।’
(সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩)
আমাদের সমাজে আজ বহু স্থানে উপরে উল্লেখিত আয়াতের প্রতিফলন দেখা যায়। দুনিয়াতে সাময়িক ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা সম্পদশালী হবার কারণে আজ অনেকেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে। অনেক মুসলমানই পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। তারা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলনের সেতুবন্ধকে ছিন্ন করে চলছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমার আত্মীয়রাই তো সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন না। আমি একাই এর জন্য দায়ী নই। কিন্তু এ বক্তব্য তাদের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ ‘যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখবে, শুধু তার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে’- এই যদি নীতি হয় তাহলে তা আল্লাহর জন্য হলো না, বরং তা হলো বদলা। হজরত যুবাইর বিন মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আত্মীতার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তা আল্লাহ তা’আলার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে বিচ্ছিন্ন করা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার সময় এটা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, হ্যাঁ, তবে তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব? শুনে আত্মীয়তা বললঃ অবশ্যই। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তোমার জন্য এরূপই করা হবে।
(বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরও একটি হাদিসে জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, আমার কিছু আত্মীয় এমন আছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক যতই জুড়ি ততই তারা ছিন্ন করে, যতই সৎ ব্যবহার করি তারা দুর্ব্যবহার করে, সহনশীলতা অবলম্বন করলেও তারা বুঝতে চায় না। তখন রাসূল (সা.) বলেন, ‘যদি ব্যাপারটি এমনই হয়, যেমন তুমি বললে তাহলে তুমি তাদের অতি কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করলে, আর তুমি তাদের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করে চলছ, তা যদি অব্যাহত রাখতে পার তাহলে আল্লাহ সর্বদা তোমার সাহায্যকারী থাকবেন।’ (মুসলিম)

“আত্মীয়তার সম্পর্ক” রক্ষা নামক বিষয়টি আজ সমাজে খুব শীর্ণকায় এক অবয়ব। দিনদিন এটি শীর্ণকায় থেকে আরও শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছে। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। নিন্মে উল্লেখিত বিষয়গুলো মাথায় রেখে সংশোধনের পদক্ষেপ নিলে আলোচ্য কবিরা গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ হবে ইনশাআল্লাহ।
১) পারিবারিকভাবে ইসলামি শিক্ষার অভাব। একারণে আত্মীয়তার সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে তারা অজ্ঞ।
২) সামাজিক বা বংশগতভাবে আত্মীয়তার বন্ধনমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠা।
৩) সম্পদের প্রতি প্রতিযোগিতা ও মহব্বত, যা একে অপরের হক নষ্ট করার ব্যপারে ভূমিকা রাখে। আর এতে একে অপরের মাঝে মনোমালিন্য ও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
৪) অপরের প্রতি হিংসা বা ইর্ষা। অহংকার, হিংসা ইত্যাদির ব্যপারে ইসলামে ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা রয়েছে। হারিসাহ্ ইবনু ওয়াহ্ব (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীর পরিচয় বলব না? সাহাবাগণ বললেন, হ্যাঁ! অবশ্যই। তিনি বলেলেন, তারা হবে দুর্বল লোক তাদের (দুনিয়া) দুর্বলই মনে করা হতো। যারা আল্লাহর নামে শপথ করলে আল্লাহ তা পূরণ করেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামবাসীর পরিচয় জানাব না? সাহাবাগণ বললেন, হ্যাঁ, জানাবেন। তিনি বললেন, তারা হবে নিষ্ঠুর, দাম্ভিক ও অহংকারী লোক।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭০৭৯, হাদিসের মান: সহিহ হাদিস)
৫) একে-অপরকে ক্ষমা না করার প্রবণতা। তুচ্ছ বিষয়কে বড় করে দেখা। প্রবাদে আছে দু’টো কলসি পাশাপাশি রাখলেও ঠোকর খায়। এ সত্য অনুধাবন না করা। আমরা যদি অপরের অপরাধ ক্ষমা না করতে পারি, তবে নিজ অপরাধ কিভাবে অপরে (আল্লাহ) ক্ষমা করবেন এ আশা করতে পারি।
৬) ‘নিজেই সঠিক’ এ মানসিকতা লালন করা। মনে রাখা উচিৎ “নিজেই সঠিক” এ মানসিকতাই ইবলিশ শয়তানের জান্নাত থেকে জাহান্নামের ফয়সালার কারণ হয়েছিল।
৭) বন্ধু-বান্ধবকে আত্মীয়দের উপর স্থান দেয়া। বন্ধুবান্ধব কখনো আত্মীয়দের বিকল্প হতে পারে না। আজকাল অনেকে ইন্টারনেট জগতের বন্ধুকে নিজ আত্মীয়দের চেয়েও বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে যা একেবারেই ঠিক নয়।