আজ থেকে গুনে গুনে ঠিক ৫২৫ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ইতিহাসের এক কালো দিনে আন্দালুস আমাদের হাতছাড়া হয়। ৭১১ খৃস্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে একেবারে ১৪৯২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিলো এ শাসন। ১৪৯২ খৃস্টাব্দের ২ জানুয়ারি এ স্বর্গ আমাদের হাতছাড়া হয়। এ ভূমিতে জন্মেছিলেন ইমাম ইবনে আব্দিল বার, ইমাম কুরতুবি ও ইমাম ইবনে হাজমের মতো মহান মনীষী। ইবনে রুশদ, আল জাহরাউয়ির মতো দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানীরাও এ মাটির সন্তান। মুসলিম আন্দালুস শুধু আজকের স্পেন নয়, বরং স্পেনের সীমানা ছাড়িয়ে পর্তুগালেরও বিরাট একটি অংশ আন্দালুসের অধীন ছিলো। আন্দালুস মরক্কো থেকে ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। দুই দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক ব্যবধান হয়ে আছে জিব্রাল্টার প্রণালি। যার মূল উচ্চারণ ছিলোÑ জাবালুত তারিক। স্পেন বিজেতা মহাবীর তারিক বিন জিয়াদ রহ. এর নামে। অপরদিকে পিরেনিজ পর্বতমালা আন্দালুস এবং ফ্রান্সের মাঝে অন্তরায় হয়ে আছে। এ পর্বতশ্রেণী পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৩০০ মাইল বিস্তৃত। মাগরিব (বর্তমান মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া) অঞ্চলের গভর্নর মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশে স্পেন বিজেতা তারিক বিন জিয়াদ (রহ.) মাত্র ৭ হাজার সৈন্য নিয়ে আন্দালুসে আসেন। সময়টা ছিলো ৯২ হিজরির শাবান মোতাবেক ৭১১ খৃস্টাব্দের জুনে। এভাবেই জয়যাত্রা এগোতে থাকে। প্রায় ২ বছরে এ জয় পূর্ণতায় পৌঁছে। মুসলিমদের অধীন এ ভূখন্ডের দিকে পুরো মনোযোগী হন পরবর্তী সুলতানরা। রক্ত-ঘামে গড়ে তোলেন এ উদ্যান। সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ভরিয়ে তোলেন পূর্ণতার বহু উপাদানে। শুধু মুসলিম স্থাপত্যের তালিকায় জায়গা পেয়েছে আল হামরা, কর্ডোভা জামে মসজিদ থেকে শুরু করে বিশ্বনন্দিত বহু স্থাপনা। দশম শতকের মাঝামাঝিতে আন্দালুসের ইসলাম স্বর্ণযুগে পৌঁছায়। প্রায় ৫০ লাখ মুসলিমের আবাসস্থল হয় আন্দালুস, যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি। একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ উমাইয়া খেলাফত এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো। আর আন্দালুস হয়ে উঠেছিলো ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রগামী এবং স্থিতিশীল অঞ্চল।
আন্দালুসের রাজধানী কর্ডোভা আকর্ষণ করছিলো গোটা মুসলিম বিশ্বের এবং ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের। তৎকালীন ইউরোপে গোসলখানাকে হাম্মাম বলে গণ্য করা হতো, অথচ কর্ডোভায় ছিলো ৯০০ পাবলিক ওয়াশ রুম। দশম শতকে কর্ডোভায় ছিলো ৭০০ মসজিদ। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ১৫৬৭ সালে এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দালুসের মুসলিম শাসনামলে নির্মিত সব হাম্মাম (গোসলখানা) ভেঙে দেওয়া হয়। আধুনিক শল্যবিদ্যার (সার্জারি) জনক আবুল কাসিম আল যাহরাবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ, জাবির ইবনে আফলা, আবু ইসহাক ইবরাহিম আল জারকালি ও ইবনে জুহরদের ত্রিকোণমিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শল্যচিকিৎসা, ওষুধ ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত গবেষণার ফলে ইসলামী ও পশ্চিমা সমাজ অগ্রগতি অর্জন করে। আন্দালুস ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতো এবং তা মুসলিম ও খৃস্টান বিশ্বের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক আদান-প্রদানের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠে। উইকিপিডিয়ার মতে, দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত ইউরোপিয়ান দার্শনিক বিজ্ঞানী মিশেল স্কট প্রথম ইবনে রুশদের গবেষণা ইউরোপে নিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রেনেসাঁ আন্দোলনে মিশেলের প্রভাব প্রমাণিত ছিলো। আবুল কাসিম আল যাহরাবির শল্যচিকিৎসা বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ আত তাসরিফ এ ভূখ-েই রচিত হয়েছিলো। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে যা ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত ছিলো। ইমাম কুরতুবি রহ. এর বিখ্যাত তফসির ‘আল জামি লি আহকামিল কুরআন’ আজও মুসলিম বিশ্বের লাইব্রেরির অনন্য সংযোজন। ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহ. এর রচিত হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল ইসতিযকার’ এবং ‘আত তামহিদ’ বহু শতাব্দী ধরে মুসলিম গবেষকদের কাছে আদৃত সমাদৃত হয়ে আছে। যাই হোক, এ স্বর্ণযুগ চিরকাল স্থায়ী হয়নি।
১১০০ শতাব্দীর দিকে খেলাফত ভেঙে যায় এবং অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যেগুলোকে বলা হতো ‘তাইফা’। এতেও রক্ষা হলো না। মুসলিম সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে একেবারে গ্রানাডার মানচিত্রে সীমায়িত হয়ে পড়ে। এ গ্রানাডাই ছিলো আন্দালুসের শেষ মুসলিম শহর। তারপরের ইতিহাস শুধু অশ্র“ আর রক্তের। গ্রানাডার শেষ শাসক মুহাম্মদ। ১৪৯১ খৃস্টাব্দের শেষ দিকে রাজা ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার সেনাবাহিনী গ্রানাডা শহর চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। সুলতান মুহাম্মাদ তার আল-হামরা প্রাসাদের মিনার থেকে দেখতে প্রণ, খৃস্টান বাহিনী গ্রানাডা শহর বিজয়ের জন্য জড়ো হচ্ছে এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মুহাম্মাদ সবকিছু অন্ধকার দেখতে পান এবং শেষমেশ কোনো উপায়ান্তর না দেখে ১৪৯১ খৃস্টাব্দের নভেম্বরে খৃস্টানদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন, যার ফলে গ্রানাডা শহরের নিয়ন্ত্রণ খৃস্টানদের হাতে চলে যায়। ২ জানুয়ারি ১৪৯২ খৃস্টাব্দে এ চুক্তি কার্যকর হয় এবং স্পেনীয় বাহিনী গ্রানাডায় প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দালুসের সর্বশেষ মুসলিম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইতিহাস কি আবার ঘুরে দাঁড়াবে? আন্দালুস কি আবার ফিরে আসবে?
সুত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ।