রমযান আরবী বছরের ৯ম মাস। হিজরী সনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং মহিমান্বিত মাস এই রমযানুল মুবারক। পুরো রমযানব্যাপী রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরয। রমযানে রোযা রাখা ইসলামের তৃতীয় বুনিয়াদ। এ মাসে রাতে তারাবীহর নামায পড়া এবং তারাবীহর নামাযে কুরআন খতম করা সুন্নাত। এছাড়া এ রমযানেই কুরআন নাযিল হয়।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ –
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যে রকম ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের আগের সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর। যাতে তোমরা পরহেযগারি অর্জন করতে পারো।
أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ وَأَن تَصُومُوا خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ –
অর্থঃ নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য সিয়াম ফরয হয়েছে। তবে তোমাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হবে কিংবা সফরে থাকবে, সে অন্য সময়ে সিয়াম পূর্ণ করে নিবে। আর যাদের জন্য সিয়াম রাখা একেবারেই কষ্টকর, তারা সিয়ামের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করবে। যে ব্যক্তি আনন্দের সাথে সৎ কর্ম সম্পাদন করে, তা তার জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হয়। তবে এরপরেও সিয়াম রাখলে তা আরো অধিকতর কল্যাণকর। যদি তোমরা তা বুঝতে পারো।
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ –
অর্থঃ এ হলো রমযান মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে- যা মানুষের জন্য হিদায়াতের পথ দেখায় এবং এই কুরআন এমন স্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত, যা সত্য ও মিথ্যার মাঝে চুড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এ রমযান মাস পাবে, সে যেনো এ মাসে সিয়াম রাখে।
তবে তোমাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হবে কিংবা সফরে থাকবে, সে অন্য সময়ে সিয়াম পূর্ণ করে নিবে। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তিনি তোমাদের জন্য কঠোরতা কামনা করেন না। যাতে তোমরা সিয়াম গণনা করে পূর্ণ করতে পারো এবং তিনি তোমাদেরকে হিদায়াত করার কারণে তোমরা তার বড়ত্ব বর্ণনা করতে পারো। এর সাথে সাথে তাঁর শুকরিয়াও আদায় করো।
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتَانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
অর্থঃ রমযানের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হালাল করা হলো। তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ তা’আলা জানেন যে, তোমরা নিজেদের ওপর খিয়ানত করে ফেলেছিলে। এখন তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে তোমাদেরকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন।
সুতরাং তোমরা স্ত্রীগণের সাথে সহবাস করে আল্লাহ তা’আলার দেওয়া রিযিক আহরণ করে নাও। আর তোমরা রাতের কালো রেখা থেকে সুবহে সাদিকের সাদা রেখা পরিস্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত পানাহার করতে পারো। এরপর সিয়াম পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত। আর তোমরা মসজিদ সমূহে ইতিকাফ করাবস্থায় স্ত্রীগণের সাথে সহবাস করো না। এটা হলো আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত সীমারেখা; এর কাছে যেও না। আল্লাহ তা’আলা এভাবেই আয়াত সমূহ বর্ণনা করেন মানুষের জন্য, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারে। (সূরা বাকারাহ-১৮৩, ১৮৪, ১৮৫, ১৮৭)
সিয়াম সম্পর্কে কুরআনে এ চারটি আয়াত নাযিল হয়েছে। সিয়াম শব্দটি আরবী। এর অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁরই বিধান অনুযায়ী সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব রকমের পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বলা হয়।
পূর্ববর্তী যুগে সিয়াম সাধনা
মানুষের কামরিপু দমন করে ধৈর্য্য, আত্মত্যাগ ও সংযম অনুশীলনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক নবী-রাসূল ও তাঁদের উম্মতগণের ওপর সিয়াম ফরয করেছিলেন। আগের উম্মতের ওপর বিভিন্ন যুগে সিয়াম ফরয ছিলো বটে, তবে এর পদ্ধতি কিংবা মেয়াদ সর্বযুগে একই রকম ছিলো না। বিধর্মী গোষ্ঠীর মধ্যেও উপবাসের প্রচলন রয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় শেষ নবীর উম্মতের ওপরও সিয়াম ফরয করে এর পরিপূর্ণতা ঘোষণা করা হয়। আল্লামা আলুসী রহ. লিখেছেন-
কুরআনের আয়াতে তোমাদের পূর্ববর্তী” বলে নবী আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল যুগের মানুষকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে রুহুল মা’আনী)
নবী আদম আলাইহিস সালামের যুগে সিয়ামের ধরণ কেমন ছিলো- তা সঠিক জানা যায় না। তবে আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন-
ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রতি মাসে তিনদিন করে সিয়াম রাখার প্রচলন ছিলো। পরবর্তীতে রমযানের সিয়াম ফরয হলে তা রহিত হয়ে যায়। সাহাবী মু’আয রাযি., সাহাবী ইবনে মাসউদ রাযি., সাহাবী ইবনে আব্বাস রাযি., তাবেয়ী আতা রহ., কাতাদা রহ. এবং যাহহাক রহ.-এর মতে প্রতি মাসে তিনদিন সিয়াম রাখার বিধান আল্লাহর নবী নুহ আলাইহিস সালামের যুগ থেকে শুরু করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত কার্যকর ছিলো। পরে আল্লাহ তা’আলা রমযানের সিয়াম ফরয করে ওই বিধান রহিত করে দেন।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর)
রমযান মাসের প্রতিটি মুহুর্ত প্রতিটি সময় অনেক অনেক দামী। আল্লাহ তা’আলার অফুরন্ত অসীম কল্যাণ ও বরকতের ভান্ডার থেকে সবকিছু এ মাসে অবারিত করে খুলে দেওয়া হয়। বছরের অন্যান্য সময়ের পাপ-পঙ্কিলতা ও শরীর-মনের যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ঝরঝরে হয়ে যাওয়ার জন্য রমযান এক সুবর্ণ সুযোগ। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতের দরজা সরাসরি উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এ কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযান কাছাকাছি এসে পড়লে কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। মাগফিরাত ও কল্যাণ এবং সবকিছু নতুন করে শুরু করার জন্য রমযান পেতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়তেন। দুই মাস আগে থেকেই রজব মাস শুরু হলেই তিনি এ দো’আ শুরু করতেন-
اللهم بارك لنا في رجب وشعبان، وبلغنا رمضان.
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং রমযান পর্যন্ত আমাদেরকে পৌছিয়ে দিন। (মুসনাদে আহমাদ (যাওয়ায়েদ)ঃ ১/২৫৯)
হাদীসের বর্ণনায় মহিমান্বিত রমযান
রমযান সম্পর্কে হাদীসে নববীতে বিভিন্ন সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে, যা আগের কোনো উম্মতকে প্রদান করা হয়নি। সাহাবী সালমান ফারেসী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদেরকে ইরশাদ করেন-
তোমাদের মাথার ওপর এমন একটি মর্যাদাশীল বরকতময় মাস ছায়াস্বরূপ আসছে, যে মাসে লাইলাতুল কদর নামে একটি রাত আছে। এ রাতটি হাজার মাস থেকেও উত্তম। এ মাসে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করেছেন এবং রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ তারাবীহ আদায় করাকে তোমাদের জন্য পুণ্যের কাজ করে দিয়েছেন।
যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আদায় করলো, সে যেনো রমযানের বাইরে একটি ফরয আদায় করার সমতুল্য সাওয়াব অর্জন করলো। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করলো, সে যেনো রমযানের বাইরে সত্তরটি ফরয আদায় করার সমতুল্য সাওয়াব অর্জন করলো।
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
এ রমযান মাস ধৈর্য্য ধারণ করার মাস এবং এই ধৈর্য্য ধারণের বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত রেখেছেন। এ মাস মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার মাস। এ মাসে মুমিন লোকের রিযিক বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি কোনো সিয়াম আদায়কারীকে ইফতারি করাবে, এটা তার জন্য মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের কারণ হবে এবং সে উক্ত সিয়াম আদায়কারীর সাওয়াবের সমপরিমাণ সাওয়াব অর্জন করবে অথচ এ কারণে উক্ত সিয়াম আদায়কারীর সাওয়াব বিন্দু পরিমাণও কমবে না।
সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন- আমাদের অনেকেরই তো এমন সামর্থ নেই যে, কাউকে ইফতারি করাবো? নবীজি বললেন- কাউকে ইফতারি করানোর জন্য পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজন নেই। এক টুকরা খেজুর দিয়ে ইফতারি করালেও সে উক্ত সাওয়াবের অধিকারী হবে।
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
রমযান এমন এক মাস, যে মাসের প্রথম অংশে রহমত অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয় অংশে মাগফিরাত এবং শেষ অংশে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি রমযান মাসে তার কর্মচারীদের কাজের চাপ হালকা করে দেয়, আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি প্রদান করবেন।
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
রমযান মাসে তোমরা চার কাজ বেশি বেশি করবে। প্রথম দুই কাজ একমাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য এবং পরের দুই কাজ এমন, যা না করে তোমাদের উপায় নেই। প্রথম দুটি কাজ হলো- কালিামা তাইয়্যেবাহ বেশি বেশি পড়া এবং ইসতিগফার করা। পরের দুটি কাজ হলো- জান্নাত লাভ করার জন্য প্রার্থনা করা এবং জাহান্নাম থেকে রেহাই চাওয়া।
যে ব্যক্তি এই রমযান মাসে কোনো সিয়াম আদায়কারীকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তা’আলা তাকে কিয়ামতের দিবসে আমার হাইযে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যা পান করার পর জান্নাতে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না। (সহীহ ইবনে খুযাইমাহ; বায়হাকী- শু’আবুল ঈমান)
সাহাবী আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- রমযান উপলক্ষে আমার উম্মতকে এমন পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয়েছে, যা আগের কোনো উম্মতকে দেওয়া হয়নি।
এক. সিয়াম আদায়কারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তা’আলার নিকট মৃগনাভীর থেকেও উত্তম।
দুই. সমুদ্রের মাছ সিয়াম আদায়কারীর জন্য দো’আ করে।
তিন. জান্নাতকে প্রতিদিন সিয়াম আদায়কারীর জন্য সুসজ্জিত করা হয়। তখন আল্লাহ তা’আলা বলতে থাকেন- আমার বান্দাগণ খুবই দ্রুত পৃথিবীর কষ্ট-যাতনা দুরে নিক্ষেপ করে তোমার নিকট চলে আসবে।
চার. রমযান মাসে দুর্বত্ত শয়তানকে শৃংখল দিয়ে বেঁধে আটকে রাখা হয়। যার ফলে শয়তান মানুষকে ওই সমস্ত পাপাচারিতা করার জন্য প্ররোচনা দিতে পারে না, যা রমযানের বাইরে করে থাকে।
পাঁচ. শেষ রাতে সিয়াম আদায়কারীর সর্বপ্রকার গোনাহ মাফ হয়ে যায়।
সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন- এই ক্ষমা কি লাইলাতুল কদরে হয়ে থাকে? নবীজি বললেন- না; বরং নিয়ম হলো- শ্রমিক কাজ শেষ করার পর তার পারিশ্রমিক লাভ করে থাকে।
(মুসনাদে আহমাদ; মুসনাদে বাযযার; বায়হাকী)
রমযানে সিয়াম সাধনার বাস্তব অনুশীলন ও এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি যে মাত্রায় অর্জিত হবে, আল্লাহ তা’আলার কাছে এর পুরস্কারও তত মাত্রায় উন্নত ও মহামূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। এ কারণে আল্লাহ তা’আলা নিজে হাদীসে কুদসীতে বলেন-
এ সিয়াম একমাত্র আমার জন্যই। আমি আমার সিয়াম আদায়কারী বান্দাকে নিজ হাতে পুরস্কার প্রদান করবো।
রমযানে তারাবীহ আদায়
রমযানে এশার সালাত আদায় করার পরে বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে আদায় করা সুন্নাত। পুরো রমযান মাসে এ তারাবীহ সালাতে কুরআন খতম করা স্বতন্ত্র সুন্নাত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তারাবীহ সালাত আদায় করেছেন। তবে উম্মাহর ওপর এ সালাত ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকায় মাঝে মাঝে তিনি তারাবীহ আদায় করা ছেড়ে দিয়েছেন।
কারণ নবীজির নিয়মিত কোনো আমল উম্মতের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য হতো। এ প্রসঙ্গে তিনি ইরশাদ করেন- আমার ভয় হয় যে, আমার উম্মতের ওপর তারাবীহ ফরয হয়ে যায় কিনা।
অবশ্য নবীজির সাহাবীগণ নিয়মিত তারাবীহ আদায় করেছেন। নববী ও ইসলামের প্রথম যুগে মদীনা মুনাওয়ারার বিভিন্ন স্থানে তারাবীহর জামাত হতো। পরবর্তীতে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর যুগে সম্মিলিতভাবে জামাতের সাথে বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করার ব্যাপারে উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
হাদীসের বর্ণনায় তারাবীহ আদায়
তারাবীহ সম্পর্কে হাদীসে সাহাবী সালমান ফারেসী রাযি. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে-
এ মাসে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করেছেন এবং রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ তারাবীহ আদায় করাকে তোমাদের জন্য পুণ্যের কাজ করে দিয়েছেন। (সহীহ ইবনে খুযাইমাহ; বায়হাকী- শু’আবুল ঈমান)
রমযানে বিশেষ সতর্কতা লক্ষ্যণীয়
রমযানের কর্তব্য ও দায়িত্ব শুধু উপবাস থাকার মাঝে সীমিত নয়। পানাহার বর্জন করার সাথে সাথে সিয়াম আদায়কারীকে সর্বপ্রকার পাপাচারিতা ও অশ্লীর কর্মকান্ড থেকে বিশেষভাবে বেঁচে থাকতে হবে। যেসব কার্যাবলী রমযানের বাইরেও হারাম, সেগুলো রমযানেও পরিহার না করলে এ উপবাস থাকা রমযানের সাথে উপহাস মাত্র। এ প্রসঙ্গে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তি সিয়াম রেখেও মিথ্যাচারিতা ও অন্যান্য পাপাচারিতা পরিহার করে না, তার পানাহার বর্জন করা আল্লাহ তা’আলার কোনো প্রয়োজন নেই। (সহীহুল বুখারী)
রমযানের হাকীকত ও তাৎপর্য
রমযান এমন এক অনুশীলন, যার মাধ্যমে মানুষের শরীর ও আত্মা উভয়টিরই আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়। মানুষের পাশবিক ও জৈবিক অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সিয়ামের বিকল্প নেই। সংগত কারণেই রমযানের সিয়ামের মর্যাদা ও গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম বলেন-
সিয়ামের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তার পাশবিকতা ও জৈবিক চাহিদার উচ্ছৃংখলতা থেকে মুক্ত করা। সাথে সাথে এ জৈবিক চাহিদার মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা সৃষ্টি করা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। চিরন্তন জীবনে অনন্ত সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করে।
এর ফলে মানুষের পাশবিকতা নিস্তেজ হয়ে তার অভ্যন্তরে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। এছাড়া সিয়াম সাধনা দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। এতে শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন হয়। সর্বোপরি অন্তরের শুদ্ধি ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে সিয়ামের ভূমিকা খুবই কার্যকরি।
বিখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাযালী রহ. এ প্রসঙ্গে বলেন-
প্রত্যেক প্রাণিরই সৃষ্টিগতভাবেই কিছু প্রবৃত্তি রয়েছে। যথা- খাদ্য গ্রহণ প্রবৃত্তি, আত্মস্থ প্রবৃত্তি, বিশ্রাম ও যৌন প্রবৃত্তি। সব প্রাণি এ প্রবৃত্তিগুলো চরিতার্থ করার জন্য উদগ্রীব থাকে। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো বিধিনিষেধ মানতে চায় না। অন্যান্য প্রাণির সাথে মানুষের পার্থক্য এখানেই যে, অন্যান্য প্রাণিকুলকে বিবেক বুদ্ধি দেওয়া হয়নি। ফলে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো প্রবৃত্তি পুরণ করে থাকে। কিন্তু মানুষকে বিবেক বুদ্ধি প্রদান করা হয়েছে। সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ যাচাই করার বোধশক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষকে এ সব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
মিথ্যা ও মন্দ পথ পরিক্রমা থেকে মুক্ত থেকে সত্য সুন্দর পথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার পাশবিক ইচ্ছার তুলনায় বিবেক বোধকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। আর আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য ও তাঁর প্রতি তাকওয়া অর্জন করার সাথে সাথে এ অনুশীলন করার লক্ষ্যেই আশরাফুল মাখলুকাত মানব জাতির ওপর রমযানের সিয়াম আবশ্যক করা হয়েছে।