৩৫ হিজরীতে সাবায়ি দলের মিসরীয় নেতা সুদান ইবনে হুমরানের তরবারির আঘাতে তৃতীয় খলিফা ওসমান রাযি. শাহাদাতবরণ করেন। তখন হজের মওসুম থাকায় মদীনা ছিলো প্রায় জনশূন্য। বিশিষ্ট সাহাবীরাও ছিলেন মক্কায়। এদিকে সাবায়ি দল চাচ্ছিলো, নিজেদের সুবিধামতো কাউকে খলিফা নিযুক্ত করে ষড়যন্ত্রের পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যেতে। অবশ্য তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পরে মদীনায় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ না থাকার ফলে খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সাবায়ি দলের হাতে চলে যায়।
এ সুযোগে তারা মদীনাবাসীকে খলিফা নিযুক্ত করার জন্য তিন দিনের সময় বেঁধে দেয় এবং এর মধ্যে ব্যর্থ হলে সবাইকে হত্যা করার হুমকি প্রদান করে। সাবায়ি দলের আশংকা ছিলো, এখন যদি তৃতীয় খলিফা হত্যার বদলা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তা হলে তারা ধরা পড়ে যাবে। এদিকে সাহাবীদের কেউ কেউ চাচ্ছিলেন আগে নতুন খলিফা মনোনীত করে এরপর বদলা নিতে। এদের মধ্যে ছিলেন আলি রাযি. ও অপর বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবী।
অপরদিকে আরেক দল ভাবছিলেন ভিন্ন কথা। তাঁরা আগে বদলা নিয়ে এরপর খলিফা নিযুক্ত করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বড় বড় সাহাবীগণের অধিকাংশই এই পক্ষে ছিলেন। তাঁদের অন্যতম হলেন, সিরিয়ার গভর্নর মু’আবিয়া রাযি., তালহা রাযি., যুবায়ের রাযি. এবং আয়েশা রাযি. প্রমুখগণ।
তাই সাবায়ি দল নিজেদের আসন্ন বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে হজ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় সাহাবীশূন্য মদীনায় অবস্থানরত সাধারণ জনগণকে হুমকি দিয়ে আলি রাযি. কে খলিফা হতে বাধ্য করে। তিনি কয়েকজন সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা চিন্তা করে খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে আলি রাযি. এর খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে কোনো অভিযোগ কিংবা সমস্যা ছিলো না। কিন্তু খেলাফতে তাঁর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সাবায়িদের মূল ভূমিকা থাকার কারণে এবং সাবায়ি নেতাগণ জোর করে খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে ফেললে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের মাঝে মতভেদ দেখা দেয়। আলি রাযি. ও তাঁর সমর্থনকারীরা আগে এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এরপর তৃতীয় খলিফার হত্যাকারীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। উল্লেখ্য, ওই সময় তৃতীয় খলিফার হত্যাকারী পক্ষ নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য আলি রাযি. কে সমর্থন করে পরিস্থিতির মোড় অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।
অপরদিকে নবীজির শীর্ষস্থানীয় অনেক সাহাবী আগে তৃতীয় খলিফার হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তাঁরা হলেন তালহা রাযি., যুবায়ের রাযি., আয়েশা রাযি. এবং সিরিয়ার তৎকালীন গভর্নর মু’আবিয়া রাযি.। এভাবে দুই পক্ষ নিজেদের দাবিতে অনড় থাকলে উম্মাহ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সম্মুখীন হয়। সাবায়ি চক্র এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। পরেিশষে তারা তাদের চক্রান্তে সফল হয়।
এরপর আলি রাযি. মু’আবিয়া রাযি. কে নিজের প্রতি বাই’আত গ্রহণ করার আহবান জানান। ওদিকে মু’আবিয়া রাযি. সিরিয়াতে ওসমান রাযি. এর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার পক্ষে জনমত গঠনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলি রাযি. তাঁর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সিরিয়ায় অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অপরদিকে আয়েশা রাযি. হজ শেষে মক্কা থেকে মদীনায় ফেরার পথে ওসমান রাযি. এর শাহাদাত ও এই বিশৃংখল পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পেরে মক্কায় থেকে যান এবং সাবায়ি কর্তৃক মদীনা দখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাতে থাকেন। তাঁর সাথে তালহা রাযি. ও যুবায়ের রাযি.ও যোগ দেন।
অতঃপর তাঁদের পরামর্শে আয়েশা রাযি. এ ব্যাপারে চতুর্থ খলিফা আলি রাযি. এর ওপর চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যে সমমনা লোকদের নিয়ে বসরা নগরীর উদ্দেশে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে সাবায়িদের ভাড়াটে সন্ত্রাসী হাকিম বিন জাবালা তাঁদের ওপর আক্রমণ করে বসে। আয়েশা রাযি. সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু আলি রাযি. এর নিযুক্ত বসরার গভর্নর উসমান বিন হানিফ হাকিম বিন জাবালার পক্ষে অবস্থান নিয়ে আয়েশা রাযি. কে প্রতিহত করেন। ফলে পরিস্থিতি সংঘর্ষে রূপ নেয়। অবশেষে বসরার গভর্নর পরাজিত হলে বসরার নিয়ন্ত্রণ আয়েশা রাযি. এর হাতে চলে যায়।
আলি রাযি. এ সংবাদ জানার পর সিরিয়া অভিযান স্থগিত রেখে বসরার উদ্দেশে রাজধানী মদীনা ত্যাগ করেন। বসরা গিয়ে তিনি বিরোধী পক্ষের সাথে সন্ধি স্থাপন করার চেষ্টা করেন। এ লক্ষ্যে তিনি কা’কা’ নামের এক দূতকে আয়েশা রাযি. এর কাছে প্রেরণ করেন। দীর্ঘ আলোচনা ও যুক্তি স্থাপন শেষে উভয় পক্ষ আগে ওসমান রাযি. এর হত্যার বদলা নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয় এবং আলি রাযি. এর খেলাফতের প্রতি সর্ব সম্মতিক্রমে সমর্থন ব্যক্ত করে।
অতঃপর আলি রাযি. জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে ওসমান রাযি. এর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা শুনে সাবায়িরা ভয় পেয়ে যায়। তারা ভাবতে লাগলো, আলি রাযি. ও আয়েশা রাযি. এর পক্ষের মাঝে ঐক্য কার্যকর হলে তাদের ওপর দিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। কারণ তারা ভালো করেই জানতো, ওসমান রাযি. কে তারাই হত্যা করেছে। ফলে তারা নতুন চক্রান্তে মেতে উঠে।
সাহাবীদের দুই পক্ষের মাঝে সন্ধি স্থাপিত হওয়ার পরে সবাই নিজ নিজ শিবিরে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লো। এরপর সাবায়িদের লোকেরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে রাতের অন্ধকারেই ঘুমন্ত সাহাবীদের ওপর হামলা করলো। এক দল আলি রাযি. এর শিবিরে এবং অপর দল আয়েশা রাযি. এর শিবিরে আক্রমণ চালালো। এর সাথে তারা উভয় পক্ষের শিবিরেই অপর পক্ষের বিশ্বাসঘাতকতা ও আক্রমণ করার গুজব ছড়িয়ে দিলো। ফলে উভয় পক্ষ একে অপরকে ভুল বুঝে যুদ্ধে জড়িযে পড়লো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সাবায়িদের ভাড়াটে খুনি আয়েশা রাযি. কে হত্যা করতে চেষ্টা করলেও বিফল হয়। এরপর তারা তাঁর উটের চালককে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানালে তা প্রতিহত করার জন্য একে একে ৭০ জন প্রাণোৎসর্গকারী বীর সাবায়িদের হাতে নিহত হন। এই অনাকাংখিত যুদ্ধে সাবায়িদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিশিষ্ট দুই সাহাবী তালহা ও যুবায়ের রাযি. শহীদ হন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ জঙ্গে জামাল নামে প্রসিদ্ধ। এর মাধ্যমে সাবায়িরা আবারো সফল হয়।
অতঃপর আলি রাযি. সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। সেখানে তিনি যুদ্ধ এড়িয়ে গভর্নর মু’আবিয়া রাযি. এর সাথেও সন্ধি করতে চাচ্ছিলেন। এদিকে আলি রাযি. এর সাথে সাবায়ি দল সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগেই ছিলো। আলি রাযি. গভর্নর মু’আবিয়া রাযি. এর সাথে আলোচনা করার জন্য যে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন, ওই দলেও সাবায়ি গুপ্তচর ছিলো। দারা যে কোনোভাবে এই সন্ধিপ্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিতে চাইছিলো। তাই তারা আলোচনার শুরুতেই গভর্নর মু’আবিয়া রাযি. এর সাথে অসজ্যেন্নমূলক আচরণ করে এবং তাঁকে গালমন্দ করতে থাকে। বারবার যুদ্ধের হুমকি দিতে থাকে।
সাবায়িদের এই আচরণে সিরিয়ার জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং অধিকাংশ লোক মু’আবিয়া রাযি. এর মতের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। ফলে এখানেও তাঁদের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়। এক পক্ষে ছিলেন আলি রাযি. এবং অপর পক্ষে মু’আবিয়া রাযি.। এক পর্যায়ে যুদ্ধে আলি রাযি. জয়লাভ করার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তখন যুদ্ধ চলাকালীন হঠাৎ করে মু’আবিয়া রাযি. এর বাহিনীর লোকেরা তীরের মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে কুরআনের ফয়সালা মেনে নেওয়ার জন্য উভয়পক্ষকে আহবান জানায়।
আলি রাযি. এটাকে পরাজয় এড়ানোর কৌশল মনে করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এতে সাবায়ি চক্র নিজেদের বিপদ আঁচ করতে থাকে। কারণ আলি রাযি. জয়ী হলে সবার আগে ওসমান রাযি. এর হত্যার বদলা নেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাছাড়া এর ফলে ঐক্যবদ্ধ খেলাফত ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে। যা সাবায়ি গোষ্ঠী কখনোই মেনে নিতে পারেনি। তাই এহেন পরিস্থিতিতে তারা আলি রাযি. এর পরাজয় কামনা করছিলো।
অবশেষে সাবায়ি চক্র আলি রাযি. কে কুরআনের দোহাই দেখিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ করে। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলে তারা তাঁকে হত্যা করার হুমকি দেয়। ওই সময় সাবায়িদের আরেকটি দল আলি রাযি. এর বাহিনীর সদস্যদেরকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করে ফেলে। ফলে পরিস্থিতি আলি রাযি. এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হন। এবারেও সাবায়িরা সফল হয়।
অতঃপর আলি রাযি. এবং মু’আবিয়া রাযি. উভয়েই দুই দলের পক্ষ থেকে একজন করে সালিস নিয়োগ করার ব্যাপারে একমত হলেন। সালিস যতক্ষণ কুরআনের বিরুদ্ধে কোনো ফয়সালা না দিবে, ততক্ষণ সালিস যে সমাধান দিবে, উভয় পক্ষই তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। এরপর উভয় পক্ষ এর ওপর সম্মতি দিয়ে সালিস নিয়োগ দেয়। আলি রাযি. এর পক্ষ থেকে সাহাবী আবু মূসা আশ’আরি রাযি. কে এবং মু’আবিয়া রাযি. এর পক্ষ থেকে মিসর বিজয়ী সাহাবী আমর ইবনুল আস রাযি. কে সালিস নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা উভয়ে কুরআনের বিধান অনুযায়ী ফয়সালা দেওয়ার ওপর শপথ গ্রহণ করেন। তাঁদেরকে এর জন্য ছয় মাসের সময় দেওয়া হয়। এই ছয় মাস আলি রাযি. এবং মু’আবিয়া রাযি. উভয়েই আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তখন সাবায়ি গোষ্ঠী এই সালিশি চুক্তির সমর্থনকারী জনগণকে কাফের ঘোষণা করে তাদেরকে হত্যা করা বৈধ বলে ঘোষণা করে বিভিন্ন স্থানে লুটপাট ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। আলি রাযি. তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন এবং এর মূল হোতাদেরকে হত্যা করেন। তাই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আলি রাযি. এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তাঁকে শহীদ করে দেয়। ইতিহাসে আলি রাযি. এর পক্ষ ত্যাগকারী এই দলটিই খারেজি নামে প্রসিদ্ধ।