নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমরা একে অপরের সাহায্য ও ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি। সবল-দুর্বল এবং ধনী-গরীবের এক অপূর্ব সমন্বয়ে টিকে আছে পৃথিবী। জীবনমানের এ ব্যবধানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহান স্রষ্টার রহস্য। এমন ব্যবধান ও কম-বেশি আছে বলেই পৃথিবী আজ কর্মময়।
স্বয়ং আল্লাহ পাক বিষয়টি জানাচ্ছেন সূরা যুখরুফের ৪৩ নং আয়াতে, ‘আমিই তো পৃথিবীতে তাদের মধ্যে জীবনযাপনের মান ভাগ করে দিয়েছি এবং একজনকে অন্যের উপর সম্মান দিয়েছি।’ তবে তিনি এও বলে দিয়েছেন- এ ব্যবধান আমার কাছে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, বরং যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু- সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানীত।
কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী তো বটেই, নিজেদের ঘরের টুকটাক কাজের প্রয়োজনে আমরা কাজের মানুষ রাখি। কাজের ছেলে কিংবা মেয়ে- ঘরের পরিচ্ছন্নতা থেকে নিয়ে রান্নাবান্না এবং পরিবেশনের কষ্টকর কাজ তারা করছে দিনের পর দিন। মাস শেষে বেতনের আশায় তারা মুখ বুঁজে সয়ে যান গৃহকর্তার বকাবকি ও অত্যাচার কিংবা সামান্য ভুলের জন্য অনেক জঘন্য গালিগালাজ অথবা কখনো শারীরিক প্রহার।
আজ চৌদ্দশ বছর পেরিয়ে এসেও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা নুয়ে আসে আমাদের প্রিয়তম রাসুলের উদারতা ও দূরদর্শিতা দেখে। সুদূর মদীনার এ মহান নবী শুধু নামাজ কিংবা রোজার ইবাদত শেখাতে নয়, বরং ঘরের অসহায় কাজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে, তাও বলে গিয়েছেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এ কাজের লোকগুলো তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ পাক এদেরকে তোমাদের আওতায় এনেছেন। তোমরা যে খাবার খাও, তাদেরকেও তেমন খাদ্য দিও। আর তোমাদের কাপড়-চোপড়ের মতো ওদেরকেও পোষাক পরতে দিও। তাদের সাধ্যের বাইরে কোন কাজ দিও না। যদি দিয়ে ফেল, তবে তোমরাও তাদের সঙ্গে সাহায্য করো।’ (সহীহ মুসলিম-৩১৩৯)
শুধু মৌখিক নির্দেশনা নয়, তিনি তা বাস্তবেও করে দেখিয়েছেন। এক-দু কিংবা পাঁচ-ছয় বছর নয়, একাধারে দশটি বছর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সেবা করেছেন হযরত আনাস রা.। রাসুলের ঘরে বাইরের কাজগুলো তিনিই করতেন। তবুও তো ভুল হতো। আবার কখনো তিনিও ভুলে যেতেন। ইচ্ছা অনিচ্ছায় ত্র“টি হতো। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোনোদিন আহ কিংবা উফ শব্দটুকুও বলেননি। এমন হয়েছে কেন? অমন করেছো কেন? আর বকা-ঝকা কিংবা চড় থাপ্পড় তো দূরের কথা।
রান্নাঘরের চুলার পাশে আগুনের তাপ ও গরম ধোয়া সহ্য করে দিনভর যে মানুষগুলো রান্না করে চলেছে আমাদের অন্ন আহার- তাদের কথা ভুলে থাকেননি প্রিয় নবীজি। তাইতো তিনি বলেছেন, তোমাদের গোলাম-খাদেম (কিংবা কাজের মানুষরা) যখন খাবার রান্না করে তোমাদের সামনে নিয়ে আসে, অথচ সে এতোক্ষণ এর ধোয়া ও উত্তাপ সহ্য করেছে- তোমরা তাকে ডেকে তোমাদের সঙ্গে বসতে দাও, তাকে খেতে দাও। খাবার যদি অল্প হয়, যা তাকে পেটভরে দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয় তবে অন্তত তার হাতে এক-দু লোকমা উঠিয়ে দাও। (সহীহুল বুখারি)
তিনি ছিলেন মানবতার নবী। ধনী-গরীব এবং সুখী-অসহায় সবার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন সর্বসময়। মৃত্যুশয্যায়ও তিনি ভুলে থাকেননি এ অসহায় গরীব গোলাম-খাদেম কিংবা চাকর-বাকরদের কথা। তাঁর মৃত্যুর পর যেন তারা অবহেলিত না হয়- সেজন্য তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের অধিকারের কথা।
হাদীসের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত ঘটনাসমূহ থেকে জানা যায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখে সর্বশেষ উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে তিনি বারবার শুধু নামাজ এবং চাকর ও দাস-দাসীদের কথা বলে গেছেন। নামাজের মাধ্যমে তিনি আল্লাহ পাকের সব ইবাদত ও হক আদায়ের ইঙ্গিত করেছেন। তেমনিভাবে চাকর ও দাসদের কথা বলে মানুষে মানুষের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য পূরণের প্রতি জোর দিয়ে গেলেন।
একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, তারই এক সাহাবি হজরত আবু মাসউদ এক চাকরকে মারধর করছেন। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, শোনো হে আবু মাসউদ! মনে রেখো, তুমি এ গোলামটির সঙ্গে যে অধিকার দেখাচ্ছো, মহান আল্লাহ এর চেয়েও বেশি তোমার ব্যাপারে শক্তিশালী ও অধিকারী।’ এমন কথা শুনে অনুতপ্ত সাহাবি তখনই তাকে মুক্ত করে দিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, এটি যদি তুমি না করতে তবে অবশ্যই তোমাকে আগুনে জ্বলতে হতো।’ (সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে তিরমিযী)
একটু কি লক্ষ্য করবেন, নিজের কেনা গোলামের গায়ে হাত তোলার কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সাহাবীকে কেমন সতর্ক করলেন। কেনা গোলামের ব্যাপারে যদি এই হয়, তবে আজকাল যারা ঘরে কাজের মানুষ- তাদের বিষয়টি কতো ভয়ংকর! সে তো আর আপনার কেনা গোলাম নয়। সে একজন পূর্ণ ও স্বাধীন মানুষ, তারও রয়েছে সম্মান ও অধিকার- ইসলাম ছাড়া এসব আর কে শিখিয়েছে?
একলোক এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করছিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার গোলাম বা খাদেমকে কয়বার মাফ করবো? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থাকলেন। লোকটি তৃতীয়বার প্রশ্ন করলে উত্তরে নবীজি বললেন, প্রতিদিন ৭০ বার। (সুনানে তিরমিজি)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই তার ঘরে কিংবা বাইরে খাদেমকে দেখলে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার কি কিছু লাগবে? একদিন তার এমনই প্রশ্নের উত্তরে এক খাদেম বলে ফেলল, জ্বী ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার লাগবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, তোমার প্রয়োজন খুলে বলো। খাদেম বলতে লাগল, আমার একটিই দাবি, আপনি আমার জন্য কিয়ামতের মাঠে সুপারিশ করবেন।
হজরত রবীআ নামে আরেক খাদেমের কাছে গিয়ে তিনি খোঁজ নিতেন, তুমি বিয়ে-শাদী করছো না কেন?’ তেমনিভাবে এক ইহুদি ছেলে তার কিছু কাজ করে দিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অসুস্থতার সংবাদে স্বয়ং ওই ইহুদী ছেলেটির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
নিজের খাদেমদেরকে কাছে ডেকে তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও আমলের খবর নিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এও বলেছেন, তোমার গোলামের উপর যেটুকু কাজ তুমি হালকা করে দিলে, তা অবশ্যই তোমার নেকির পাল্লায় যোগ হবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান)
একটি বিষয়ে এখানে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। কারণে-অকারণে কিংবা নিজের ছেলে-মেয়ে হোক অথবা চাকর-বাকর, কারোর চেহারায় কখনো মারা যাবে না। শিক্ষা দেয়া কিংবা শাস্তিমূলক- যে কারণেই হোক- মুসলিম শরীফের ২৬১২ নং সহ অন্যন্য হাদীসেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাষায় নিষেধ করেছেন, কেউ যেন অন্যের চেহারায় কখনো আঘাত না করে।’
চেহারা একজন মানুষের সবচেয়ে সম্মানিত অঙ্গ, এটিই তার পরিচয়- তাই কখনো কোন মানুষের চেহারায় হাত তোলা নয়। চাই সে নিজের সন্তান কিংবা ঘরের কাজের মানুষ হোক না কেন, ছোট কিংবা বড়। চেহারার প্রতিটি অঙ্গ স্পর্শকাতর- চোখ, নাক, কান এবং মুখ, কাজেই এসবের যে কোনো অসম্মান কিংবা অসাবধানতাবশত ক্ষতি যেন না হয়- এটিও এ হাদীসে বর্ণিত নিষেধের একটি কারণ বলে ইমাম নববী মত দিয়েছেন।
শ্রমিকের বেতন ঠিক সময়ে পূর্ণভাবে আদায় করা নিয়ে অসংখ্য তাগিদ ও এর অনাদায়ে ধমক বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। যে তার শ্রমিকের পাওনা আদায়ে গড়িমসি করছে স্বয়ং আল্লাহ পাক তার প্রতিপক্ষ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার বেতন শোধ করতে বলেছেন। মোহ কিংবা অবহেলায় যেন এসব পাপে আমরা জড়িয়ে না পড়ি, বরং একজন সচেতন মুমিন হিসেবে সবার অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হবো- এটাই তো আমার ঈমানের পরিচয়।
সভ্যতার এ আধুনিক সময়েও আজকাল পত্র-পত্রিকার পাতায় ঘরের কাজের মানুষের প্রতি অকথ্য ও অসহনীয় নির্যাতনের খবর দেখা যায়। শহুরে শিক্ষিত হয়েও আমরা সামান্য অপরাধে কাজের মেয়েটিকে কঠিন শাস্তি দিয়ে স্বস্তি অনুভব করছি। কারণে অকারণে তার মা-বাবা এবং গোষ্ঠী তুলে গালিগালাজ করছি। আমরা কি ভুলে বসে আছি, একজন শক্তিমান আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং শুনছেন, আমাদের প্রতিটি শব্দ ও কর্মকান্ড সব লিপিবদ্ধ হচ্ছে পাপ-পূণ্যের খাতায়।
নিজেকেই না হয় প্রশ্ন করুন, ঘরের অসহায় কাজের মানুষটিকে পড়ালেখা শেখানো তো দূরের কথা, শেষ কবে নিজের ওদের সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন? এ কি ইসলামের শিক্ষা নয়?