পুরো বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসে কাঁপছে। চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম প্রান্তে এ ভাইরাস হানা দিয়েছে। গতকালের তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত ২০০ টি দেশে করোনা ছোবল মেরেছে। প্রায় আট লাখের কাছাকাছি এতে আক্রান্ত এবং ৩৮০০০ মানুষ করোনার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্বয়ং চিকিৎসকও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
অফিস-আদালতে কাজকর্ম নিষিদ্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। আমদানি-রপ্তানিতে ভাটা পড়ছে। রাস্তাঘাট ও বাজার বন্দরে জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কাবা চত্বরও এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। গত কয়েকশ বছরেও যে দৃশ্য দেখেনি কেউ। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ। মসজিদ-মাদরাসা, গীর্জা ও চার্চ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন ঘরে বসেই অফিসের কাজ করে ইউরোপের লোকেরা জীবিকা সচল রাখার চেষ্টা করছে। রেস্তোরায় ও কফি শপে বসে পানাহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশে দেশে বিমানবন্দর বন্ধ। হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে বিশ্ব মহামারি বলে ঘোষণা দিয়েছে।
তাছাড়া মানুষ যুগে যুগে নিজেদের অজান্তে কতো রকমের বিপদ-আপদ ও দুর্যোগের কবলে পড়ছে। মহামারি ছাড়াও ভূমিকম্প, ঝড়-তুফান, দুর্ভিক্ষ, সড়ক দূর্ঘটনা, বোমা হামলা, নিত্য-নতুন রোগব্যাধি এবং এই জাতীয় বিভিন্ন রকমের দূর্ঘটনা প্রতিদিনের অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কখনোই আগের যুগে দেখা যায়নি। অথচ তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এসব দুর্যোগ ও সংকট মূলত আমাদের স্বভাবের বিকৃতি ও বদ-আমলের পরিণাম।
এর আগে পৃথিবীতে অনেক মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর মহান খলিফাদের আমলেও মহামারি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু করোনভাইরাসের মতো বিশ্ব মহামারির নজির এটাই প্রথম।
পৃথিবীতে এমন কি আজকাল সংঘটিত হচ্ছে না, যা পর্যালোচনা করলে আমরা আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যত বাণীর সাথে এর মিল খুজে পাই না! বিষ্ময়করভাবে তাঁর প্রতিটি কথাই এখন হুবহু বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। শুধু বাকি আমাদের শিক্ষা নেওয়ার। আরেকটু সতর্ক হওয়ার!!
সাহাবী আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত,নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
যখন গণীমতের মালকে নিজস্ব মালিকানাধীন ধন-সম্পদ মনে করবে,আমানত হিসেবে রাখা বস্তুকে গণীমতের মাল মনে করবে (অর্থাৎ, আমানতের মাল আদায় না করে নিজেই খেয়ে ফেলবে) এবং যাকাতকে জরিমানা মনে করবে (সন্তুষ্টচিত্তে যাকাত আদায় না করে মনে বিরক্তি নিয়ে তা আদায় করবে), পার্থিব উপার্জনের উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করবে, পুরুষ লোকেরা তাদের স্ত্রী আনুগত্য করবে, মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধুকে কাছে রাখবে, পিতাকে দূরে সরিয়ে দিবে, মসজিদের ভিতরে আওয়ায উচ্চ হবে, গোত্র বা সম্প্রদায়ের পাপাচারী লোকেরা তাদের নেতা হবে, সমাজের সবচেয়ে হীন, ইতর লোকেরা সমাজের পরিচালনার ভার গ্রহণ করবে, কোনো লোককে তার আচরণের শিকার হওয়ার ভয়ে সম্মান করা হবে (তাকে অন্তর থেকে ভালোবেসে না), মদ্যপান ছড়িয়ে পড়বে, এই উম্মতের পরবর্তীরা তাদের পূর্ববর্তীদেরকে অভিশাপ দিবে- তখন তারা যেনো প্রবল ঝঞ্চাবায়ু, ভূমিধ্বস, সমূলে ধ্বংস, মানুষের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাওয়া এবং আসমান থেকে পাথর বর্ষণ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। সাথে সাথে হারের সুতা ছিড়ে যাওয়ার ফলে তা থেকে একটার পর একটা ধারাবাহিকভাবে মোতির দানা পড়ে যাওয়ার মতো একটার পর একটা বিভিন্ন দূর্যোগ ও দূর্ঘটনার অপেক্ষায় থাকে।
(সুনানে তিরমিযীঃ হা-২২১১)

সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. বলেন,প্রিয় নবীজি ইরশাদ করেন-
যখনই কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে; এমনকি তারা প্রকাশ্যে নির্লজ্জ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে, তখন অবশ্যই তাদের মাঝে এমন নতুন নতুন মহামারি ও যন্ত্রণাকর ব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়,যা এর আগে কখনোই কারও মাঝে দেখা দেয়নি।
(সুনানে ইবনে মাজাহ; বাবুল উকুবাতঃ হা-৪০১৯)
অন্য এক রেওয়ায়াতে বদ-আমলের ভয়ানক পরিণামের প্রতি ইঙ্গিত করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
যখন কোনো জাতির মাঝে বাড়াবাড়ি করা প্রকাশ পায়, তখন তাদের অন্তরে ভয়-ভীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যখন কোনো জাতির মাঝে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। যখন কোনো জাতির লোকেরা দ্রব্য-সামগ্রী ওজন করতে গিয়ে কম দেওয়া শুরু করে, তখন তারা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। যখন কোনো জাতির মাঝে অন্যায়-অবিচার বেড়ে যায়, তখন তাদের মাঝে রক্তপাত বৃদ্ধি পায়। যখন কোনো জাতি ওয়াদা ভঙ্গ করতে শুরু করে, তখন তাদের ওপর শত্র“কে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
(মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেকঃ হা-৯৮১)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,
কোনো জাতির মধ্যে আত্মসাৎ করা বৃদ্ধি পেলে সে জাতির লোকদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করা হয়। কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিমাপ ও ওজনে কম দিলে তাদের রিজিক সংকুচিত করা হয়। কোনো জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে বিচার-ফয়সালা করলে তাদের মধ্যে রক্তপাত বিস্তৃতি লাভ করে। কোনো জাতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আল্লাহ শত্রুদের তাদের ওপর চাপিয়ে দেন।
(মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেকঃ হা-১৩২৩)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
হে মুহাম্মদের উম্মত, আল্লাহর শপথ! আল্লাহর চেয়ে রাগী আর কেউ নেই, তিনি রাগ করেন তাঁর সেই বান্দা-বান্দির প্রতি, যে ব্যভিচার করে। হে মুহাম্মদের উম্মত, আল্লাহর শপথ, আমি যা জানি যদি তোমরা তা জানতে, তাহলে অবশ্যই কম হাসতে এবং বেশি বেশি কাঁদতে।
(সহিহ বুখারি,সহিহ মুসলিম,মিশকাত,হা-১৪৮৩)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
সপ্ত আকাশ এবং সপ্ত জমিন বিবাহিত ব্যভিচারীর প্রতি অভিশম্পাত করে। জাহান্নামে এদের লজ্জাস্থান থেকে এমন দুর্গন্ধ বের হবে, যা জাহান্নামিরাও সহ্য করতে পারবে না। আগুনের আজাবের সঙ্গে সঙ্গে জাহান্নামে তারা লাঞ্ছনাও ভোগ করবে। (বাজজাজ)
উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে আমরা নিজেরাই নির্ধারণ করি যে, আমাদের মধ্যে এসবের কোনটি নেই? সব ধরণের পাপাচারিতা ও মন্দ কাজগুলো একই সময়ে আমাদের মাঝে বিদ্যমান। অন্যায়-অবিচার, বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যার কাঁধে ভর করে অন্যকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় আমরা যেনো বিভোর। হালাল হারামের তোয়াক্কা না করে নেশার ঘোরের মতো দিনরাত আমরা ছুটে চলছি কিছুদিনের উপার্জনের দিকে। আর তাই বাজার-বন্দর, সিনেমা হল এবং শপিং মল জনসমাগমে কোলাহলে ভরপুর থাকলেও মসজিদ ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। এতো কিছুর পরেও আমরা যে এখনও টিকে আছি, তাই বা কম কীসে?? করোনাভাইরাস নিশ্চিতভাবে মহান রবের পক্ষ থেকে রেড এলার্ট!!
আল্লাহ আমাদের হিদায়াত করুন …..