পৃথিবীর ব্যবস্থাপনাকে ত্যাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে। ত্যাগ বিসর্জন দিয়ে বিজয় লাভ করা অথবা কোনো কিছু অর্জন করা পৃথিবীর ধর্ম। ত্যাগের বিপরীতে রয়েছে ভোগ। ভোগের মাধ্যমে আনন্দ লাভ করা যায়। তবে তা নিতান্তই সাময়িক। এর কোনো স্থায়িত্বই নেই। অপরদিকে প্রথমে ত্যাগ করলে এর ফলে যা লাভ হয়, যে আনন্দ শুরু হয়- তা হয় চিরস্থায়ী। তাই ইসলামের শিক্ষা ত্যাগকে অবলম্বন করে। ইসলাম মানবকে ত্যাগের দিকে আহবান করে আর চিরস্থায়ী আনন্দ ও সফলতার দিকে ধাবিত করে। অপরদিকে শয়তান ও নফস মানবকে ভোগের দিকে আহবান করে আর ক্ষণস্থায়ী আনন্দের লোভ দেখিয়ে চিরদিনের যন্ত্রণা ও যাতনার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
কোনো জাতি ধর্ম কিংবা সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে ত্যাগ চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। অর্থ-সম্পত্তির ত্যাগ, সময়ের বিসর্জন অথবা প্রয়োজনে মানবের রক্তও ত্যাগ করতে হয়। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানব রক্ত বইয়ে গেলেও তা বৃথা যায় না। এ কারণেই সত্য প্রতিষ্ঠার জিহাদে মু’মিনকে উভয় দিক থেকেই পুরস্কৃত করা হয়েছে। তাঁর সব দিকই সাফল্যমন্ডিত। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি জিহাদে বিজয় অর্জন করলে গাযী উপাধিতে ভূষিত হয়। গণীমতের সম্পদ লাভ করে। আবার মৃত্যুবরণ করলে শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করে। তাঁর রুহ একটা সবুজ পাখির ভিতর স্থাপিত হয়ে চিরস্থায়ী সুখের আবাসন জান্নাতে উড়ে বেড়ায়।
কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির শাশ্বত সুন্দর জীবনবিধান ইসলাম শুরু থেকেই ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ত্যাগের বিনিময়েই পৃথিবীতে এর প্রসার ঘটেছে। ইসলামের বাহক এর প্রচারক নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ইসলামকে সবার আগে সব কিছুর ওপরে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি প্রেরিত দূতগণ তথা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ত্যাগ-বিসর্জনের কি কখনো তুলনা হতে পারে? আল্লাহ তা’আলার পর তাঁরা সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েও ত্যাগ-বিসর্জনকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। বরঞ্চ তাঁরা পৃথিবীর জন্য ত্যাগের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা।
ইসলামের জন্য সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য কারবালার ঘটনা এক মহান শিক্ষা। এটা আত্মত্যাগ ও নিজেকে ইসলামের জন্য বিসর্জন দিয়ে দেওয়ার জীবন্ত নমুনা। কারবালার ঘটনা আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়। শোক ও মাতমের মুহ্যমান সাগরে আমাদের বুক ভাসিয়ে দেয়। সত্য জয়ের দুর্দান্ত সাহস ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য বাসনাকে স্তব্ধ করে দেয়। আমাদের স্বর্ণালী অতীত ইতিহাসের ধ্বামান গতির প্রবাহকে থামিয়ে দেয়। সত্যিই এই ঘটনা বড়ই বেদনার। কিন্তু এই বেদনার নির্মম ঘটনাই সত্যের জন্য ন্যায়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার জযবাকে জীবন্ত করে তোলে। আমাদের হৃদয়ে অনাবিল আনন্দের অনুভুতি সম্পন্ন অভাবনীয় এক অনুপ্রেরণার জাগরণ সৃষ্টি করে।
সুতরাং এই বেদনাকে প্রশমিত করার শিক্ষা কারবালার ঘটনার মধ্যেই রয়েছে। জীবনের সব কষ্ট-যাতনাকে আল্লাহ তা’আলার জন্য উৎসর্গ করলে এই বেদনা সহজেই প্রশমিত হয়। আমাদের দায়িত্ব হলো একে প্রশমিত করে আত্মত্যাগের শিক্ষাকে গ্রহণ করা। কারবালার শোককে শক্তিতে পরিণত করে এর মাধ্যমে নিজেকে ইসলামের জন্য বিসর্জন দেওয়া। এটাই প্রকৃত সফলতা। পৃথিবীর কয়েক দিনের জীবনের মূল স্বার্থকতা। আত্মত্যাগের মর্ম ভুলে গিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়ে থাকলে সর্বদিক থেকেই ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে উঠে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদরের দৌহিত্র সাইয়্যেদুনা হোসাইন রাযি. খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছা করলে খুব সহজেই তা পারতেন। নববী সন্তানের পরিচয়কে পুঁজি করে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে চাইলে এটা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই ছিলো না। অপরদিকে তিনি ইচ্ছা করলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন অযোগ্য খলীফার বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকতেও পারতেন। কিছু সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারতেন। ক্ষমতাও গ্রহণ করলেন না আবার প্রতিবাদ থেকেও তিনি পিছু হটলেন না। এই উভয় পদক্ষেপই তিনি ইসলামের জন্যই গ্রহণ করেছিলেন।
আত্মত্যাগ বিজয়কে ছিনিয়ে এনে দেয়। এটাই তিনি বুঝিয়েছেন। ইরাকের কারবালার মরু প্রান্তরে আহলে বাইতের সম্মানিত সদস্যবর্গকে তিনি মৃত্যু মুখে ঠেলে দেননি। ফোরাত নদীর তীরে পানির জন্য হাহাকারে শিশুদের বুক ফাঁটা চিৎকারে তাঁর পরাজয় ঘটেনি। চক্রান্তকারীদের ছল চাতুরীর সামনে তাঁর অজ্ঞতা কিংবা কোনো ধরণের ব্যর্থতা প্রকাশ পায়নি। বরং কারবালার ময়দানে ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ অর্থাৎ নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।
তিনি আমাদেরকে আত্মত্যাগ শিক্ষা দিয়েছেন। আত্মত্যাগের ফলে হয়তোবা নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। পৃথিবী থেকে অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের মন থেকে তা কখনো মুছে যায় না। যুগে যুগে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা আমাদেরকে আত্মত্যাগের সুমহান শিক্ষার এই বার্তাই দিয়ে যায়।
আব্দুল্লাহ আল মাসূম