বর্তমান যামানায় বিভিন্ন স্থানে মুসলিম সমাজে কুরবানীর বিষয়ে কিছু সামাজিক প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যেগুলোকে মেনে চলা আবশ্যক মনে করা হয়। এসব প্রথাকে মান-সম্মান ও সামাজিক প্রভাবের মাপকাঠি বলে বিবেচনা করা হয়।
এমনকি কেউ এসব সামাজিক প্রথাকে এড়িয়ে চললে তাকে সামাজিকভাবে মানহানির শিকার হতে হয়। তাকে ভিন্ন চোখে দেখা হয়। অথচ এসব প্রচলিত প্রথা শরীয়তের মূল নির্দেশনার বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণার আলোকে বিবর্জিত। যথা-
– সমাজে এককভাবে বা কয়েকজন মিলে গরু, বকরি ইত্যাদি কুরবানী দেওয়া হয়। এরপর কুরবানীর গোশতের অর্ধেক সমাজে দেওয়া হয় এবং বাকি অর্ধেক মাথা, কলিজাসহ কুরবানীদাতা মালিক নিয়ে যায়। সমাজে দেওয়া গোশত থেকে প্রতি ঘরে সমানভাবে বন্টন করে দেওয়া হয়। এতে কুরবানীদাতাগণও সমাজের এক ভাগ পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সবার উপার্জন হালাল নাও হতে পারে। সুতরাং এমতাবস্থায় ঘরে ঘরে বন্টনকৃত গোশত সবাই খেতে পারার বিষয়টি অস্পষ্ট থেকে যায়।
– কুরবানীর চামড়া অকশন বা ডাকে বিক্রি করে টাকা সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় লোকেরা কয়েকদিন পরে কুরবানীদাতাগণকে ডেকে বিভিন্ন মাদরাসা ও সমাজের গরীব লোকদেরকে কিছু কিছু দেয় এবং অবশিষ্ট টাকা সমান ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক গরুওয়ালাকে দেয়। তারা হয়তো সবাইকে ৫০০ টাকা করে দিলো। এর মধ্যে গরু রয়েছে ২০,০০০ টাকা, ১০,০০০ টাকা, ৮,০০০ টাকা এবং ৬,০০০ টাকা মূল্যের। এখন সবাইকে ৫০০ টাকা করে দেওয়ার যথার্থতা কতটুকু- তা স্পষ্ট নয়।
– অপরদিকে সমাজের লোক এলাকার মসজিদ ও মাদরাসার জন্য যারা মাসিক চাঁদা দেয়, তাদের মধ্যে যারা বছরে বা মাসে চাঁদা আদায় করেনি বা বাকি আছে- এই সুযোগে তাদের বাকি টাকা-পয়সা আদায় করে নেয়। কুরবানীর বিষয়ে এটাই সমাজের নিয়ম।
– এছাড়া সমাজে অনেকে উপরোক্ত এসব প্রথা থেকে বেঁচে আলাদাভাবে কুরবানী করে সমাজের গরীব-দুঃখীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ বা এর চেয়ে কম-বেশি দান করে দিলে তা শরীয়তের হুকুম অনুযায়ী হবে কিনা- এ নিয়ে ভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকেন।
এই বিষয়ে জানার আগে ভূমিকাস্বরূপ কিছু বিষয় জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
কোনো এলাকার অধিবাসী সকল মুসলিম যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সামাজিক সংঘ গড়ে তোলেন, তাহলে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় বিষয়। এই সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য হবে ‘তা’আউন আলাল বিররি ওয়াত-তাকওয়া’ অর্থাৎ পুণ্য ও খোদাভীতির কাজে পরস্পর সহযোগিতা, অসহায়, নিপীড়িত ও দুর্গত মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হওয়া এবং শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কজে বাধা প্রদান করা।
এজন্য এই ধরণের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি বা দায়িত্বশীলদের মধ্যে আলিম ও যোগ্যতাসম্পন্ন দ্বীনদার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন। অন্তত আলিমগণের নিকট প্রয়োজনীয় মাসায়েল জিজ্ঞাসা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তাদের সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য সফল হয়।
মুসলমানদের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য তাই- যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় কিছু অতি উৎসাহী মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মধ্যে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সম্মিলিতরূপ দিতে চান, যেগুলোকে শরীয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ সাব্যস্ত করেছে এবং ব্যক্তির ইচ্ছা স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এই ধরণের পদক্ষেপ হলো ভালো নিয়তে ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করার মতো। আর শুধু নিয়ত ভালো হলেই কাজ ভালো হয় না।
ভালো কাজ সেটাই- যার পদ্ধতি সঠিক। কোনো ঐচ্ছিক বিষয়কে অপরিহার্য বানানো, ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদনযোগ্য বিষয়কে সম্মিলিতরূপ দেওয়া এবং তাতে সকলের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, চাই তা মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে হোক কিংবা বাধ্যবাধকতার পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে হোক, এগুলো বিভিন্ন কারণে ভুল। যথা-
১. এই ধরণের উদ্যোগের মাধ্যমে শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। কেননা শরীয়ত তো বিশেষ উদ্দেশ্যেই এই বিষয়গুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখেছে।
২. এর মাধ্যমে শরীয়ত নির্দেশিত পন্থা পরিবর্তন করা হয়।
৩. শরীয়ত নির্দেশিত পন্থা পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে অনেক জটিলতা ও শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দিত অনেক বিষয়ের অবতারণা ঘটে। এসব জটিলতা এড়ানোর একমাত্র পদ্ধতি হলো শরীয়ত যে বিষয়কে ‘ইনফিরাদ’ বা ব্যক্তি পর্যায়ে রেখেছে- তাকে সম্মিলিতরূপ না দেওয়া এবং যে কাজ ঐচ্ছিক রেখেছে- তাকে অপরিহার্য না করা।
কুরবানী একটি ইনফিরাদি তথা ব্যক্তিগতভাবে আদায়যোগ্য আমল। ঈদের দিন সম্মিলিতভাবে সবাইকে জামাতে নামায আদায় করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কুরবানীর পশু কোথায় যবেহ করবে, গোশত কিভাবে বন্টন করবে- এই বিষয়গুলো শরীয়ত সম্পূর্ণরূপে কুরবানীদাতার ইচ্ছা ও স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে একত্রিত হতে বলেছেন, কিন্তু কুরবানীর পশু যবেহ করার জন্য কোনো বিষেশ স্থান নির্ধারণ করেননি অথবা সবাইকে বিশেষ কোনো স্থানেও একত্রিত হতে বলেননি। তিনি গোশতের ব্যাপারে বলেছেন-
নিজে খাও অন্যকে খাওয়াও, দান করো এবং ইচ্ছা হলে কিছু সংরক্ষণ করো। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে এই কথা বলেননি যে, তোমরা গোশতের একটি অংশ আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি তা বন্টন করে দিবো কিংবা এই আদেশ ও দেননি যে, তোমরা নিজেদের এলাকা ও মহল্লার কুরবানীর গোশতের একটি অংশ একস্থানে জমা করবে এবং এলাকার নেতৃস্থানীয় লোকেরা তা বন্টন করবে।
যথা- হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
উম্মুল মু’মিনীন আয়শা রাযি. বলেন, একবার গ্রাম থেকে অনেক গরীব মানুষ ঈদুল আযহার সময় শহরে এসেছিলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা কুরবানীর গোশত তিন দিন পর্যন্ত রাখতে পারবে।
এরপর যা উদ্বৃত্ব থাকবে তা সদকা করে দিবে। পরের বছর কুরবানীর সময় বললেন, আমি সেবার গরীব মানুষের উপস্থিতির কারণে তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা নিজেরা খেতে পারো, সংরক্ষণ করতে পারো এবং দান করতে পারো। (সহীহ মুসলিমঃ হা-১৯৭১)
তোমরা নিজেরা খাও, সফরে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখো এবং আগামীর জন্য সংরক্ষণ করো।
(সহীহ বুখারীঃ হা-১৭১৯; সহীহ মুসলিমঃ হা-১৯৭২)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বলেছিলেন-
হে মদীনাবাসী! তোমরা তিনদিনের অধিক কুরবানীর গোশত খাবে না। (অর্থাৎ তিন দিন পর যা থাকবে- তা দান করে দিবে)। পরের বছর সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন- অনেকের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তোমরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সংরক্ষণ করে রাখো। আমি সে সময় ওই কথা এজন্য বলেছিলাম এই কারণে যে, মানুষের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র বেশি ছিলো। এজন্য গরীব লোকদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন অধিক ছিলো।
(সহীহ মুসলিমঃ হা-১৯৭৩; সহীহ বুখারীঃ হা-৫৫৬৯)
তোমরা কুরবানীর গোশত থেকে যে পরিমাণ ইচ্ছা খাও, অন্যদেরকে খাওয়াও, সফরে পাথেয়রূপে সঙ্গে রাখো এবং যে পরিমাণ ইচ্ছা, আগামীর জন্য সংরক্ষণ করো।
(সুনানে নাসায়ীঃ হা-৪৪২৯-৪৪৩০; সুনানে তিরমিযীঃ ১৫১০)
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরবানীর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
তিনি কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ স্বীয় পরিবারের সদস্যদেরকে খাওয়াতেন, এক তৃতীয়াংশ গরীব প্রতিবেশিদেরকে খাওয়াতেন এবং এক তৃতীয়াংশ প্রার্থনাকারীদের দান করতেন।
(আল-ওযাইফ-আবু মূসা আল-মাদানী; আল-মুগনী-ইবনে কুদামাঃ ১৩/৩৭৯-৩৮০)
ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রহ. তাঁর হাদীসের বিখ্যাত কিতাব ‘আল-মুয়াত্তায়’ এই বিষয়ের হাদীসগুলো লিখেছেন যে, কুরবানীর গোশতের সদকার পরিমাণ যেনো এক তৃতীয়াংশ থেকে কম না হয়। অবশ্য কেউ যদি এক তৃতীয়াংশ থেকে কম সদকা করে, তাহলে সেটা না-জায়েযও হবে না।
কুরবানীর চামড়ার ব্যাপারে শরীয়তের শিক্ষা
— কুরবানীদাতা ইচ্ছা করলে তা প্রক্রিয়াজাত করে নিজে ব্যাবহার করতে পারে।
(মুসনাদে আহমদঃ হা-১৬১৬৩; বাদায়েউস সানায়েঃ ৪/২২৫; আল-মুহাল্লা বিল আছারঃ ৬/৫১-৫৩)
— পুরো চামড়া গরীব মিসকীনকে, বিষেশত তারা যদি দ্বীনদার হয়, সদকা করতে পারবে। এটাই উত্তম। তাই কুরবানীদাতা যাকে ইচ্ছা, তা সদকা করতে পারে। কিন্তু চামড়া বা তার মূল্য দ্বারা কসাইকে পারিশ্রমিক দেওয়া সম্পূর্ণ না-জায়েয। কসাইয়ের পারিশ্রমিক ভিন্ন অর্থ থেকে দিতে হবে।
(ফাতহুল বারীঃ ৩/৬৫-৬৫১; আল-মুহাল্লা ৬/৫১-৫৩)
— যদি একাধিক গরীব-মিসকীনকে সদকা করতে চায়, তবে এই উদ্দেশ্যে তা বিক্রি করা যাবে। বিক্রি করার পর প্রাপ্ত অর্থ নিজ প্রয়োজনে ব্যাবহার করা মোটেই জায়েয নয়। এই অর্থ যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত গরীব-মিসকীনকে সদকা করে দেওয়া আবশ্যক।
(বাদেউস সানায়েঃ ৪/২২৫; তাকমীলা ফাতহুল কাদীরঃ ৮/৪৩৬-৪৩৭; ই’লাউস সুনানঃ ১৭/২৫৪-২৬০)
উপরোক্ত হাদীস ও মাসায়েল থেকে পরিস্কার হয়েছে যে, কুরবানীদাতা তার কুরবানীর গোশত কি পরিমাণ রাখবে, কি পরিমাণ অন্যকে খাওয়াবে, কি পরিমাণ সদকা করবে এবং কি পরিমাণ আগামীর জন্য সংরক্ষণ করবে- এগুলো সম্পূর্ণ তার ইচ্ছার ব্যাপার।
যে কুরবানীদাতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি, তিনি যদি সব গোশত তার পরিবারের জন্য রেখে দেন, তবে এটারও সুযোগ রয়েছে। তবে ক্ষুধা ও দারিদ্রের সময় গরীব-মিসকীন ও পাড়া-প্রতিবেশির প্রতি লক্ষ্য রাখা একদিকে যেমন মানবতার দাবি, অন্যদিকে তা ঈমানী কর্তব্যও বটে। আর যার সামর্থ্য আছে, তিনি যদি অল্প কিছু গোশত নিজেদের জন্য রেখে বাকি সব গোশত সদকা করে দেন, তবে এটাও ভালো কাজ। মোটকথা এই বিষয়টি শরীয়ত কুরবানীদাতার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এখানে অন্য কারো অনুপ্রবেশ অনুমোদিত নয়।
তদ্রুপ কুরবানীর চামড়ার বিষয়টিও শরীয়ত কুরবানীদাতার ওপরই ছেড়ে দিয়েছে। কুরবানীদাতা শরীয়তের মাসআলা মোতাবেক যা ইচ্ছা, তাই করতে পারবে। এখানে অন্য কারো বাধ্যবাধকতা আরোপের কোনো অধিকার নেই।
মাসায়েল জানা না থাকার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশ্নোক্ত যে পদ্ধতিটি প্রচলিত হয়েছে এতে দেখা যাচ্ছে, একটি ব্যক্তিগত ও ঐচ্ছিক বিষয়ে অঘোষিতভাবে এক ধরণের বাধ্যবাধকতা আরোপের কারণে নানা ধরণের অশোভনীয় ও আপত্তিকর বিষয়ের অবতারনা হচ্ছে। যথা-
১) অনেকে নিজেদের বিবেচনা মতো কুরবানীর গোশত বিভিন্নজনকে হাদিয়া কিংবা সদকা করতে চান। তদ্রুপ চামড়াও নিজের বিবেচনা মতো সদকা করতে চান।
কিন্তু এই সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হন, নিজেন স্বাধীন বিবেচনা মতো করতে পারেন না। অথচ হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- কোনো মুসলমানের সম্পদ তার মনের সন্তুষ্টি ব্যতিত হালাল নয়। (মুসনাদে আহমদ; শু’আবুল ঈমান)
২) অনেকেই সবার হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক বন্ধনের কারণে প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য, এই ধরণের বাধ্যবাধকতাহীন বিষয়াদিতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেই দুরস্ত নয়।
৩) এই ধরণের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপের একটি ক্ষতি হলো, সমাজের লোকজনের মধ্যে একটি গুঞ্জন সৃষ্টি হয় যে, অমুকের সম্পদ সন্দেহজনক, অমুকের আয়-রোযগার হারাম, কিন্তু তার কুবানীর গোশতও সবাইকে খেতে হচ্ছে! ইত্যাদি। এখন এই জাতীয় কথাবার্তা শুধু অনুমান নির্ভর হোক বা বাস্তবভিত্তিক- উভয় ক্ষেত্রেই এই ধরণের আলোচনা-সমালোচনা দ্বারা সমাজের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং ঝগড়া-বিবাদের সুত্রপাত ঘটে।
এর দ্বারা একদিকে যেমন সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, অন্যদিকে কুধারণা, গীবত অভিযোগ এবং হিংসা-বিদ্বেষের গোনাহে লিপ্ত হতে হয়। তাছাড়া বাস্তবিকই যদি সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে- যাদের আয়-রোযগার হারাম পন্থায় হয়, সেক্ষেত্রে জেনে বুঝে তাদের কুরবানীর গোশত সমাজের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যে একটি গোনাহর কাজ- তাতো বলাই বাহুল্য।
৪) প্রত্যেক এলাকায় পুরো সমাজের কুরবানীর গোশত কাটা এবং তার বন্টনের বন্দোবস্ত করার জন্য নির্ধারিত স্থান থাকে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই কারো বাড়ির আঙ্গিনা বা বাংলো ঘর ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে বাড়ির মালিক প্রতি বছর তার বাড়িতে এসব কাজ-কর্ম করার জন্য খুশি মনে অনুমতি দিবেন- এমনটা নাও হতে পারে। অনেক সময় তো এই নিয়ে ঝগড়া-বিবাদও হতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্থানেতো এমন কান্ডও করা হয় যে, কোনো উপযুক্ত জায়গা না থাকায় মসজিদেন মধ্যে এই কাজ আরম্ভ করা হয়- নাউযুবিল্লাহ। এর দ্বারা মসজিদের সম্মান কি পরিমাণ বিনষ্ট হয়- তা সহজেই অনুমেয়।
৫) এরপর যেসব অঞ্চলে সমাজ প্রথা চালু আছে, সেসব অঞ্চলের গোশত গ্রহণ ও বন্টনের পদ্ধতি এক নয়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই কাজ করা হয়। প্রত্যেক পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও আপত্তিকর বিষয় বিদ্যমান রয়েছে। সবগুলো আলাদাভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কেননা উল্লেখিত আপত্তিগুলোই এই মূল পদ্ধতি বর্জনীয় হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
যদি এই প্রথার ভিন্ন কোনো সমস্য নাও থাকে, তবুও এই সমস্য তো অবশ্যই আছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে যে বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ ছিলো এবং কুরবানীদাতার ইচ্ছা-স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো- তাতে বাধ্যবধকতা আরোপ করা হয়েছে। এই মৌলিক সমস্যাই উপরোক্ত প্রথা আপত্তিকর ও বর্জনীয় হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে শরীয়তের শিক্ষা ও নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেককে তার কুরবানীর বিষয়ে স্বাধীন রাখতে হবে। যথা-
কুরবানীদাতা নিজ দায়িত্ব ও বিবেচনামতো যে পরিমাণ হাদিয়া করতে চান, করবেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় থেকে শত শত বছর যাবত এই পদ্ধতিই চলমান ছিলো এবং এখনো সুন্নাতের অনুসারী আলিম ও দ্বীনদার মানুষের মধ্যে এই পদ্ধতিই চালু রয়েছে। সুতরাং এই পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরী। বিশেষত এই ফিতনার যুগে নানামূখী ঝামেলা, মনোমালিন্য থেকে মুক্ত থাকার এটাই একমাত্র পন্থা এবং স্বাভাবিকভাবে সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষজনও এই পন্থা গ্রহণ করতে চান।
কারো কুরবানীর অর্থ হারাম হওয়ার বিষয়টি যদি সুনির্দিষ্টভাবে জানা থাকে, তাহলে জেনে-বুঝে এই কুরবানীর গোশত হাদিয়া বা সদকা হিসেবে বণ্টন করা এবং ব্যবহার করা কোনোটাই জায়েয নয়। তবে শুধুমাত্র ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে কারো কুরবানীকে হারাম বলে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।
কুরবানীর পশুর চামড়ার প্রসঙ্গে উপরোক্ত নীতি একেবারেই বর্জনীয়। এই বিষয়টিও কুরবানীদাতার ইচ্ছা ও বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তিনি মাসআলা মোতাবেক যে সিদ্ধান্ত নিতে চান, নিবেন। জুমু’আ ও ঈদগাহে এই বিষয়টি মানুষকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, কুরবানীর চামড়ার মূল্যের হকদার তারাই- যারা যাকাতের হকদার এবং এই অর্থ সেসব ফকির-মিসকীনকে দেওয়াই উত্তম, যারা দ্বীনদার কিংবা দ্বীনি শিক্ষা-দীক্ষার মধ্যে লিপ্ত রয়েছে।
চামড়ার ব্যাপারে উপরে হাদীসের উদ্ধৃতিতে লেখা হয়েছে যে, কুরবানীদাতা তা নিজেও ব্যাবহার করতে পারবে। তবে বিক্রি করলে এর অর্থ ফকির-মিসকীনের হক হয়ে যায়। সুতরাং এমতাবস্থায় এই টাকা তাদেরকে না দিয়ে কোনো ব্যক্তিগত কাজে কিংবা সামাজিক কাজ-কর্মে লাগানো জায়েয নয়।
এছাড়া চামড়ার টাকা দ্বারা প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিতে মসজিদ-মাদরাসার বকেয়া চাঁদা উসুল করাও জায়েয নয়। শুধু এতোটুকুই ভাবুন, যে অর্থ সদকা করা জরুরী- তা দিয়ে চাঁদা উসুল করা কিভাবে সঠিক হতে পারে?
কোনো ব্যক্তি নিজ খুশিমতো শরীয়তসম্মত পন্থায় আলাদাভাবে কুরবানী দিয়ে তা থেকে এক তৃতীয়াংশ অসহায়-গরীব লোকদেরকে দান করলে কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। ভুমিকায় উল্লেখিত হাদীস ও মাসায়েল দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছে।
তবে এক তৃতীয়াংশ সদকা করতে হবে- এমনটাই জরুরী নয়। যার সামর্থ্য আছে, তিনি এর চেয়েও অধিক সদকা করতে পারবেন। অপরদিকে যার ঘরে প্রয়োজন রয়েছে, তিনি এর চেয়েও কম সদকা করতে পারবেন। এটা কুরবানীদাতার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার।
সুতরাং উপরোক্ত এসব ক্ষেত্রে অন্য কারো জবরদস্তি কিংবা কুরবানী সম্পর্কে শরীয়তের নির্দেশনা লংঘন করে কোনো কিছু করার কোনো অবকাশ নেই।