কুরবানীর চামড়া বিনিময় হিসেবে দেওয়া
কুরবানীর পশুর চামড়া কোনো কাজের বিনিময়ে দেওয়া জায়েয নেই। সুতরাং ইমাম, মুয়াজ্জিন বা অন্য কোনো কর্মচারীকে বেতন হিসাবে তা দেওয়া জায়েয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকাহঃ ১/৪৪২)
কুরবানীর চামড়া বিক্রি করলে এর হুকুম
কুরবানীর পশুর হাড় বা অন্য কোনো জিনিস বিক্রি করলে তা সদকা করা ওয়াজিব। কুরবানীর চামড়া দ্বীনী মাদ্রাসার ছাত্রদের দান করা উত্তম। কারণ, এতে দ্বিগুণ সওয়াব অর্জিত হয়। গরীবকে দান করার সওয়াব ও দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে সহযোগিতা করার সওয়াব অর্জিত হয়। কিন্তু এর দ্বারা কোনো শিক্ষকের বেতন দেওয়া বা অন্য কোনো কর্মচারীর পারিশ্রমিক দেওয়া আদৌ জায়েয নয়। (জাওয়াহিরুল ফিকাহঃ ১/৪৪২)
কুরবানীর চামড়া নিজে ব্যবহার করার হুকুম
– চামড়া বিক্রি না করে নিজেও ব্যবহার করতে পারে এবং অপরকেও হাদিয়া হিসাবে দেওয়া যেতে পারে। ফকির বা মিসকীনকেও দান করা যায়। যদি টাকা-পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করা হয়- তাহলে তার একমাত্র হকদার গরীব-মিসকীন। ধনী ও কর্মচারীকে কাজের বিনিময়ে এবং শিক্ষককে বেতন হিসাবে তা দেওয়া জায়েয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া)
– কুরবানীর চামড়ার উপযুক্ত কারা এবং কোন খাতে ব্যবহার করা যাবে । যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত একমাত্র তারাই কুরবানীর চামড়ার পয়সা পাবে। চামড়া বিক্রি করার পর যে পয়সা হাতে আসে, হুবহু তাই দান করবে। তার মধ্যে পরিবর্তন করা ভালো নয়।
– কুরবানীর চামড়ার পয়সা দিয়ে মসজিদ, মাদরাসা তৈরি করা বা মেরামত করা অথবা জনহিতকর কোনো কাজ করা (যেমন- রাস্তা-ঘাট, পুল ইত্যাদি নির্মাণ) জায়েয নয়।
– কুরবানীর পশুর চামড়ার মূল্য ঈদগাহ মেরামতের কাজে খরচ করা জয়েয নয়। কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রয়লব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরী। তবে কুরবানীর পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করা বা বিক্রয় করে তার মূল্য সদকা করার চেয়ে মূল্য চামড়া সদকা করাই উত্তম।
(রদ্দুল মুহতারঃ ৫/২০৯; ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৩/৪৮৯; কিফায়াতুল মুফতীঃ ৮/২৩৮; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়াঃ ৪/৩০৫; আদ্দুররুল মুখতারঃ ৬/৩২৮; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ৫/৩০১)
কুরবানীর চামড়া বিক্রি করার সময় সদকার নিয়ত করা
কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করতে চাইলে মূল্য সদকা করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করবে। সদকার নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েয ও গুনাহ। নিয়ত যাই হোক, বিক্রয়লব্ধ অর্থ পুরোটাই সদকা করে দেওয়া আবশ্যক। (ফতোওয়া হিন্দিয়াঃ ৫/৩০১; কাযীখানঃ ৩/৩৫৪)
চামড়া সংক্রান্ত একটি জরুরি আলোচনা
কুরবানীর পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবে। গোশতের মতো অন্যকে উপহারও দিতে পারবে। তবে উত্তম হচ্ছে পশুর চামড়া কোনো মাদরাসার পরিচালককে উপহার দিয়ে দেওয়া। তাহলে তিনি এটা বিক্রি করে মাদরাসার যে কোনো কাজে লাগাতে পারবেন।
উল্লেখ্য, বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হলো মাদরাসা। তাই মাদরাসায় আর্থিক সহায়তা করা সব মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। কুরবানীর পশুর চামড়া দানের মাধ্যমে আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারি। চামড়া যদি বিক্রি করা হয়- তাহলে এর মূল্য অবশ্যই গরীব মানুষের মধ্যে দান করে দিতে হবে। নিজে ব্যবহার করা যাবে না।
চেষ্টা করা উচিত- চামড়ার টাকা পরিবর্তন না করে হুবহু দান করে দিতে। চামড়া সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার চেয়ে কোনো মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করা উত্তম। কারণ তারা এ থেকে উপার্জিত সম্পূর্ণ অর্থ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করবেন। আমাদের এ বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে খেয়াল রাখা উচিত।
মসজিদে চামড়া দান
কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রয় করার পর তার মূল্য ওয়াজিব সদকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। হিদায়া কিতাবে আছে- কুরবানীর চামড়া বিক্রয় করার পর তা যাকাত ইত্যাদির মতো সদকা করা ওয়াজিব হয়ে যায়। সুতরাং এর ব্যয়ের খাত যাকাতের ব্যয়ের খাতের অনুরূপ।
আর যাকাত এবং অন্যান্য সদকার মধ্যে যেহেতু অন্যকে মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত; তাই তা মসজিদ নির্মাণ বা ইত্যাদি খাতে ব্যয় করা কোনোভাবেই জায়েয নয়। কারণ এক্ষেত্রে মালিক বানানোর বিষয়টি অনুপস্থিত। এছাড়া মসজিদের নির্মাণ কাজ বা মৃতব্যক্তির দাফন-কাফনের মধ্যেও মালিক বানিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অনুপস্থিত। কাজেই সে খাতে খরচ করা যাবে না। (হিদায়া; দুরুল মুখতার)
যদি মসজিদের কর্তৃপক্ষ অথবা ইমামের কাছে এ শর্তে পশুর চামড়া প্রদান করা হয় যে, তারা তা বিক্রয় করে তার মূল্য মসজিদের নির্মাণ কাজে ব্যয় করবে, তা হলে তা জায়েয হবে না। কারণ এক্ষেত্রে মালিক বানিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অনুপস্থিত। কেননা মালিক বানিয়ে দেওয়ার অর্থই হলো উক্ত টাকা-সম্পদ খরচের ক্ষেত্রে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা।
আর আলোচ্য ক্ষেত্রে এরূপ মালিক বানানোর বিষয়টি অনুপস্থিত; বরং দাতা তা মসজিদের নির্মাণ কাজের ব্যয় করার জন্য প্রদান করেছে। এটি তামলীক বা মালিক বানিয়ে দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা উকিল বানানোর (অর্থাৎ মসজিদের নির্মাণ কাজে ব্যয় করার জন্য অন্যকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করার) আওতাভুক্ত।
কুরবানীকারীর জন্য যেমন পশুর চামড়ার মূল্য মসজিদের নির্মাণ কাজে ব্যয় করার অনুমতি নেই, ঠিক তেমনিভাবে তা অন্যের মাধ্যমে ব্যয় করানোর অনুমতিও তার নেই। তাই অন্যকে এ কাজের জন্য উকিল বানানো (প্রতিনিধি নিযুক্ত করা) ও জায়েয নয়।
প্রকাশ থাকে যে, মসজিদ কর্তৃপক্ষ অথবা ইমামকে চামড়ার মালিক বানানো হয় না। তারা শুধু সঠিক খাতে তা ব্যয় করার উকিল (প্রতিনিধি) হয়ে থাকেন। (আযীযুল ফাতাওয়াঃ ১/৭১১-৭১২)
চামড়ার মূল্যে কৌশল গ্রহণ করা
কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রয় করলে তার মূল্য গরীব-মিসকীনদেরকে সদকা করবে অর্থাৎ তাদেরকে উক্ত মূল্যের মালিক বানিয়ে দেওয়া আবশ্যক। এটি যাকাত ইত্যাদি ওয়াজিব সদকার অন্তর্ভুক্ত। মসজিদের নির্মাণ কাজ, সংস্কার, আলোকসজ্জা বা অন্য কোনো আসবাবপত্র ক্রয় উক্ত মূল্য দ্বারা করা যাবে না।
ফিকহের কিতাবে এর কৌশল স্বরূপ লিখা হয়েছে- উক্ত মূল্য কোনো দরিদ্র মানুষকে মালিক বানিয়ে দিয়ে তাকে বলা হবে-
তুমি উক্ত টাকা তোমার পক্ষ থেকে মসজিদের নির্মাণ কাজে খরচ করো। তবে টাকা দেওয়ার সময় এ শর্ত করবে না; বরং দেওয়ার পরে এ কথা বলবে। আর এটা সম্পূর্ণ ওই দরিদ্র ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
অর্থাৎ সে ইচ্ছা করলে নিজ থেকে তা মসজিদের জন্য খরচ করতে পারে আবার নাও করতে পারে। তাকে বাধ্য করা যাবে না। মোটকথা এ কৌশলের মাধ্যমে মসজিদের নির্মাণ কাজ বা অন্য কিছু ক্রয় করার জন্য তা খরচ করা যাবে। (আযীযুল ফাতাওয়াঃ ১/৭১৩)
কুরবানীর পশুর চামড়ার ব্যাপারে তিন প্রকারের স্বাধীনতা
কুরবানীর পশুর গোশত এবং চামড়া নিজ অবস্থায় বিদ্যমান থাকাকালে কুরবানীকারী তাতে তিন ধরনের স্বাধীনতা রয়েছে।
এক. নিজে খাওয়া এবং ব্যবহার করা।
দুই. নিজের ধনী প্রিয়জনকে খাওয়ানো বা ব্যবহার করতে দিয়ে দেওয়া।
তিন. গরীব-মিসকিনকে দিয়ে দেওয়া
আর যদি গোশত বা চামড়া নগদ টাকায় বিক্রয় করে দেওয়া অথবা এমন কিছুর বিনিময়ে বিক্রয় করে, যা বিদ্যমান রেখে তা রেখে উপকৃত হওয়া যায় না। যথা- খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রয় করা ইত্যাদি। তা হলে এমতাবস্থায় গোশত বা চামড়ার বিক্রীত টাকা বা খাদ্যদ্রব্য সদকা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। নিজে খাওয়া বা কোনো ধনী ব্যক্তিকে খাওয়ানো জায়েয নয়। গোশত বা চামড়ার মূল্য সদকার নিয়তে বিক্রয় করুক বা নিজে ভোগ করার নিয়তে বিক্রয় করুক, সকল অবস্থাতেই উপর্যুক্ত হুকুম প্রযোজ্য অর্থাৎ উভয় অবস্থাতেই সদকা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
কুরবানীর পশুর চামড়া বা গোশতের মূল্য সদকা করার নিয়তে এগুলো বিক্রয় করা জায়েয। তবে নিজে ভোগ করার নিয়তে বিক্রয় করা গুনাহের কাজ। তবে উক্ত বিক্রয় চুক্তি সহীহ বিবেচিত হবে।
কুরবানীর চামড়া (এবং গোশত) বিক্রয় করে দিলে তার মূল্য সদকা করা ওয়াজিব হয়ে যায় এবং তার মূল্য প্রদান করা যায় শুধু গরীব মিসকিনদেরকে। ধনীদেরকে তা প্রদান করা যাবে না। এমনিভাবে তা শিক্ষকগণের বেতনেও ব্যয় করা যায় না। কারণ কোনো মিসকীনকে কোনোরূপ বিনিময় ছাড়া প্রদান করাই হলো সদকার হাকীকত।
যদি বেতনের খাতে ব্যয় করা হয়, তা হলে বিনিময় হয়ে যায়। আর যদি ধনীদেরকে প্রদান করা হয়, তা হলে সেখানে ‘সদকা’ শব্দ ব্যবহার করলেও মূলত তা হিবা বিবেচিত হবে। তবে যদি মূল গোশত বা চামড়া নিজে খাওয়া বা ব্যবহার করা অথবা অন্য কোনো ধনী লোককে খাওয়ানো বা ব্যবহার করতে দেওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয।