কিয়ামতের আগে ‘দাজ্জাল’ পৃথিবীতে এতো ফিতনা-ফাসাদ করবে, যা হবে কল্পনাতীত ও ভয়ংকর।
দাজ্জাল শব্দের শাব্দিক অর্থঃ এর অর্থ সত্য গোপনকারী, মারাত্মক বিভ্রান্তকারী।
পারিভাষিক অর্থঃ বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আসীরের বক্তব্য অনুসারে দাজ্জাল মেষ যুগে আবির্ভুত এমন একজনের নাম, যে সমগ্র পৃথিবীতে নজিরবিহীন সন্ত্রাস ও আতংক সৃষ্টি করবে। সর্বপ্রান্তে সে বিভ্রান্তির ঝড় বইয়ে দিবে। সে অদ্ভুত কিছু ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং খোদায়ী শক্তির দাবি করবে।
ইবনু সীদা’র বক্তব্য অনুযায়ী দাজ্জাল ইয়াহুদী বংশোদ্ভুত হবে। (লিসানুল আরব)
দাজ্জালের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ দাজ্জাল কানা হবে এবং তার চোখ ঠিকরানো হবে। দেখতে হরিৎবর্ণ কাঁচের মতো হবে। তার চুল হবে হাবশী লোকদের চুলের মতো কোকড়ানো। তার কপালে কাফির শব্দ লেখা থাকবে। (সহীহুল বুখারী- কিতাবুল আম্বিয়া; সহীহ মুসলিমঃ ২/৪০০)
হাদীসের বর্ণনায় দাজ্জাল ও তার ফিতনা
দাজ্জাল ও তার ফিতনা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে একাধিক বর্ণনাভঙ্গি ও শব্দে বিস্তারিত বলা হয়েছে। যার বিবরণ নিম্নরূপঃ
দাজ্জালের আবির্ভাব কিয়ামতের একটি পূর্বলক্ষণ। মাহদীর আগমনের পরেই তার প্রকাশ ঘটবে। এরপর মাহদী ও দাজ্জালের মাঝে সংঘর্ষ হবে।
দাজ্জালের প্রথম প্রকাশ হবে ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে। সেখানে প্রথমে সে নিজেকে নবী বলে দাবি করবে। এরপর সে ইরানের ইস্পাহান নগরীতে গিয়ে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে। ওই সময় সত্তর হাজার ইয়াহুদী তার অনুসারী হবে।
কোনো কোনো বর্ণনায় খুরাসান ও ইস্পাহান নগরীর কথাও পাওয়া যায়।
(সহীহ বুখারী- কিতাবুল আম্বিয়া; সহীহ মুসলিমঃ ২/৪০৫; মুসনাদে আহমাদঃ ১/৪-৭, ৬/৭৫; সুনানে ইবনে মাজাহ- কিতাবুল ফিতান)
দাজ্জালের সময় পৃথিবীর অবস্থা
দাজ্জালের আবির্ভাবের আগ মুহুর্তে পুরো পৃথিবী দুর্ভিক্ষ কবলিত হবে। ফলে মানুষ সীমাহীন অভাব ও দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হবে।
দাজ্জালের কাছে একটি বাগান ও একটি বিশাল অগ্নিকুন্ড থাকবে। বাগানকে সে জান্নাত এবং অগ্নিকুন্ডকে জাহান্নাম বলে প্রচার করবে। দাজ্জালের দ্বারা নানা রকমের অলৌকিক কর্মকান্ড প্রকাশ পাবে। যথা- আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ, বৃক্ষে ফল ধারণ, মৃতকে কবর থেকে জীবিত করে উঠানো, মেঘের মতো দ্রুত ধাবমান গতিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পরিভ্রমন ইত্যাদি। (সহীহ মুসলিমঃ ২/৪০১)
পৃথিবীতে দাজ্জালের ভয়াবহ ফিতনা ৪০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হবে। প্রথম দিন আমাদের সাধারণ বর্ষের হিসেবে এক বছর পরিমাণ পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। দ্বিতীয় দিন এক মাসের সমান এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহ পরিমাণ দীর্ঘ হবে। এর পরের অবশিষ্ট দিনগুলো পৃথিবীর অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতো হবে।
দাজ্জাল সমগ্র পৃথিবীকে নিজের করতলে নিয়ে আসবে। তবে সে মক্কা মুকাররামাহ ও মদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করতে পারবে না। দাজ্জালের বাহিনী মদীনা মুনাওয়ারার উপকন্ঠে পৌঁছানোর পরে মদীনা শহরে পর্যায়ক্রমে তিনটি ভূমিকম্প হবে। যার ফলে পথভ্রষ্ট ও মুনাফিক লোকেরা ভীত হয়ে মদীনা মুনাওয়ারা ছেড়ে চলে যাবে এবং দাজ্জালের প্রতারণার জালে আটকা পড়বে।
তখন মদীনা শহরের এক লোক দাজ্জালের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। দাজ্জালকে দেখামাত্রই তিনি বলবেন- এই সেই অভিশপ্ত দাজ্জাল; এতে কোনো সন্দেহ নেই। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগেই এ সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন।
এ কথা শোনা মাত্রই দাজ্জালের নির্দেশে তাকে করাত দিয়ে টুকরো করে ফেলা হবে। অতঃপর দাজ্জাল নিজের কলা কৌশলে ওই ব্যক্তির খন্ডিত দেহকে সংযুক্ত করে তাঁকে জীবিত করবে।
এরপর এই লোক পুনরায় বজ্রকন্ঠে বলতে থাকবেন- আমি নিশ্চিত, তুমিই দাজ্জাল। তখন দাজ্জাল আবারো তাকে হত্যা করতে চাইবে, কিন্তু এবার সে ব্যর্থ হয়ে যাবে। এই মহান ব্যক্তি হবেন খাদির।
দাজ্জালের অনুসারীদের অধিকাংশই হবে ইয়াহুদী, মুনাফিক, কাফির ও পথভ্রষ্ট নারী-পুরুষ।
(সহীহ মুসলিমঃ ২/৪০১-৪০৩; সুনানে ইবনে মাজাহ- কিতাবুল ফিতান; সুনানে আবি দাউদ- কিতাবুল মালাহিম)
ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ ও দাজ্জালকে হত্যা
এমনই এক মহাসংকটে দাজ্জালকে খতম করার জন্য ঈসা আলাইহিস সালাম আসমান থেকে অবতীর্ণ হবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। ঈসা আলাইহিস সালাম বর্তমানে আসমানে জীবিত অবস্থায় আছেন। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে তিনি পৃথিবীতে অবতরণ করবেন।
দাজ্জালের আবির্ভাব, মাহদীর আত্মপ্রকাশ এবং পৃথিবীতে ঈসা আলাইহিস সালামের আসমান থেকে অবতরণ কুরআন-সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মাহ দ্বারা প্রমাণিত। তাই এর কোনো একটি অস্বীকারকারী কাফির হয়ে যাবে।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর এবং সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন-
দাজ্জালের আবির্ভাব, মাহদীর আত্মপ্রকাশ এবং পৃথিবীতে ঈসা আলাইহিস সালামের আসমান থেকে অবতরণ সম্পর্কিত বর্ণিত হাদীস সমূহ মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। সুতরাং ঈসা আলাইহিস সালামের শুলে বিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে ইয়াহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও মিথ্যা। এর কোনো ভিত্তিই নেই।
এ প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِّنْهُ مَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا-
অর্থঃ ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করার ব্যাপারে খৃস্টানদের দাবি ভিত্তিহীন। কারণ প্রকৃতপক্ষে খৃস্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি। কিন্তু যারা তাঁর সম্পর্কে মতভেদ করছিলো, তারাই তাঁর ব্যাপারে বিভ্রান্ত হয়ে গেছিলো। মূলত এ ব্যাপারে তাদের অনুমান ছাড়া আর কোনো জ্ঞানই ছিলো না।
এটাই নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি; বরং আল্লাহ নিজেই তাঁকে ওপরে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা মহাপরাক্রমশালী কৌশলী। (সূরা নিসা-১৫৭)
হাদীসের বর্ণনায় ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ
সাহাবী আবু হুরায়রা রাযি. বলেন- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
ওই সত্তার কসম, যা হাতে আমার প্রাণ! অচিরেই ইবনে মারইয়াম তোমাদের মাঝে ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে অবতরণ করবেন। তাঁর চেহারা ও গঠন হিেব বিখ্যাত সাহাবী উরওয়া ইবনে মাসউদ রাযি.-এর মতো।
তিনি (খৃষ্ট ধর্মের প্রতীক) ক্রশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর নিধন করবেন এবং জিযিয়া প্রথা বিলুপ্ত করবেন। ওই সময় ধন-সম্পদের এতো প্রাচুর্য হবে যে, সেগুলো নেওয়ার কেউ থাকবে না। তখন একটি সিজদা পৃথিবী ও পৃথিবীর সব কিছুর চেয়েও উত্তম হবে।
অতঃপর সাহাবী আবু হুরায়রা রাযি. বলেন- প্রমাণ চাইলে তোমরা কুরআনের এই আয়াত তিলাওয়াত করো-
وإن مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ-
অর্থঃ ঈসা আলাইহিস সালামের মৃত্যুর আগে প্রতিটি আহলে কিতাব তাঁর ওপর ঈমান আনবে। (সূরা নিসা-১৫৯)
ঈসা আলাইহিস সালাম সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের জামে মসজিদের পূর্ব পাশের মিনারায় দুইজন ফিরিশতার সহযোগিতায় অবতরণ করবেন। তখন সেখানে মাহদী আলাইহিস সালাম স্বীয় বাহিনী সহ উপস্থিত থাকবেন।
অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম মাহদী আলাইহিস সালামের পিছে সালাত আদায় করবেন। সালাত আদায়ের পর মাহদীরই সেনা কমান্ডে তিনি হাতে একটি ছোট বর্শা নিয়ে দাজ্জালকে ধাওয়া করবেন। দাজ্জাল ঈসা আলাইহিস সালামকে দেখেই পলায়ন করতে চেষ্টা করবে। এক পর্যায়ে ফিলিস্তীনের বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী লুদ্দ নামক শহরে যাওয়ার পর দাজ্জালকে হত্যা করবেন।
দাজ্জাল নিহত হওয়ার পরে তার অনুসারীরা আশ্রয়ের জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবে। কিন্তু কোথাও তারা আশ্রয় পাবে না। দাজ্জালের অনুসারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা অধিক হবে।
(সহীহুল বুখারীঃ হা-৪৭৪১; সহীহ মুসলিম; মুসনাদে আহমাদঃ ২/৬৭)