‘ইয়াজুজ-মাজুজ’ মানব জাতিরই অন্তর্গত অতি শক্তিশালী পথভ্রষ্ট বর্বর নিকৃষ্ট শ্রেণির জাতি। তারা দুনিয়াতে ফিতনা-ফাসাদ ছড়িয়ে দিবে। নির্বিচারে হত্যাকান্ড ও লুটতারাজে তারা মেতে উঠবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলার গযবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনা থেকে এতোটুকু নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজুজ-মাজুজ মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য মানবের মতো তারা হলো নুহ আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততি। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে ইয়াজুজ-মাজুজ নুহ আলাইহিস সালামের সন্তান ইয়াসিফের বংশধর। কুরআনে তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে-
وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ-
অর্থঃ নুহের মহাপ্লাবনের পরে পৃথিবীতে যত মানুষ হবে এবং থাকবে, তারা সবাই নুহ আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততি বলে গণ্য হবে। (সূরা সাফফাত-৭৭)
হাদীসের বর্ণনায় ইয়াজুজ-মাজুজের পরিচয়
সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাযি. বলেন- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মানবজাতিকে সর্বমোট দশভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে ইয়াজুজ-মাজুজের লোকেরাই হলো নয় ভাগ। আর অবশিষ্ট এক ভাগ হলো সারা বিশ্বের মানুষ। (মুসতাদরাকে হাকিম; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ইবনে কাসীর)
সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাযি. বলেন- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তা’আলা প্রথম নবী আদম আলাইহিস সালামকে বলবেন- আপনি আপনার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামীদেরকে তুলে আনুন। তিনি আরয করবেন- হে পরওয়ারদিগার! তারা কারা?
আল্লাহ তা’আলা বলবেন- প্রতি হাজারে একজন জান্নাতী এবং নয়শক নিরানব্বই জন জাহান্নামী হবেন।
এ কথা শোনে সাহাবীগণ ভয়ে শিউরে উঠলেন। তাঁরা নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সে একজন জান্নাতী কে হবেন? তিনি ইরশাদ করলেন- চিন্তা করো না। কারণ এই একজন জান্নাতী তোমাদের মধ্য থেকে এবং নয়শত নিরানব্বই জন জাহান্নামী ইয়াজুজ-মাজুজের মধ্য থেকে হবে।
(সহীহুল বুখারীঃ হা-৪৭৪১; সহীহ মুসলিম)
ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব
ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব কিয়ামতের পূর্বলক্ষণ। (সহীহ মুসলিমঃ ২/৩৭২)
ইয়াজুজ-মাজুজের সম্প্রদায় বর্তমানে যুলকারনাইন বাদশাহ কর্তৃক নির্মিত প্রাচীরের কারণে অপর পাড়ে আটক হয়ে আছে। দাজ্জাল ধবংস হওয়ার পরেই এ সম্প্রদায় বের হয়ে সমগ্র পৃথিবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
তখন যুলকারনাইনের ওই প্রাচীর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশেই বিধ্বস্ত হয়ে সমতল ভূমির সাথে মিশে সমান হয়ে যাবে। তাদের বর্বর হত্যাকান্ড ও লুটতারাজ দমন করার সাধ্য কারোই থাকবে না।
(তাফসীরে রুহুল মা’আনি; তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন, সূরা কাহফ- মুফতী শফি)
সাহাবী নাওয়ায বিন সাম’আন রাযি. বলেন-
দাজ্জাল নিহত হওয়ার পরপরই আল্লাহ তা’আলা ইয়াজুজ-মাজুজের পথ খুলে দিবেন। তখন তাদের দ্রুত চলার কারণে মনে হবে, যেনো তারা ওপর থেকে পিছলে নিচে এসে পড়ছে। তাদের প্রথম দলটি তাবরিয়া উপসাগরের কাছ দিয়ে অতিক্রম করার সময় এর পানি পান করে এমন অবস্থা করে দিবে যে, তাদেরই দ্বিতীয় দলটি এসে সেখানে যে কোনো দিন পানি ছিলো, এ কথা বিশ্বাস করতে পারবে না।
ওই সময় ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর সঙ্গীসহ মিসরের তুর পর্বতে আশ্রয় নিবেন। অন্যান্য মুসলিম লোকেরা নিজ নিজ দুর্গে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিবেন। খাদ্যসামগ্রী তাদের সাথে থাকবে, কিন্তু তাতে ঘাটতি দেখা দিবে। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও আসবাবপত্রের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যাবে। ফলে তখন সবাই একটি গরুর মস্তককে একশত দিনারের চেয়েও দামী মনে করবে।
এ পরিস্থিতিতে ঈসা আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য মুসলিমগণ আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁদের দো’আ কবুল করে মহামারি আকারে একটি রোগের বিস্তৃতি ঘটাবেন। ফলে অল্প সময়ের ভিতরেই ইয়াজুজ-মাজুজের গোষ্ঠী মৃত্যুবরণ করবে।
অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর সঙ্গীসহ তুর পর্বত থেকে নিচে নেমে এসে দেখবেন যে, পৃথিবীতে ইয়াজুজ-মাজুজের মৃতদেহের কারণে অর্ধ হাত পরিমাণও জায়গা খালি নেই। আর এ সব মৃতদেহ পঁচে যাওয়ার কারণে এগুলো থেকে সর্বত্র অসহ্য দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
এ অবস্থা দেখে আবারো ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর সঙ্গীদেরকে সাথে নিয়ে আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁদের দো’আ কবুল করে বৃহদাকার এক ধরণের পাখি প্রেরণ করবেন। এ সব পাখিদের ঘাড় হবে উটের ঘাড়ের মতো। এ পাখিগুলো ইয়াজুজ-মাজুজের মৃতদেহগুলো নিয়ে আল্লাহ তা’আলার যেখানে ইচ্ছা, সেখানে ফেলে দিবে।
আব্দুল্লাহ আল মাসুম অপর কিছু বর্ণনামতে মৃতদেহগুলো সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর পুরো পৃথিবীর সর্বত্র একযোগে প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হবে। পৃথিবীর কোনো শহর কিংবা বন্দর এ বৃষ্টি থেকে বাদ যাবে না। ফলে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ ধৌত হয়ে কাচের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম)
আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, তাবরিয়া উপসাগর অতিক্রম করার পর ইয়াজুজ-মাজুজ বায়তুল মুকাদ্দাস সংলগ্ন খামার নামক পাহাড়ে আরোহন করে ঘোষণা করবে, আমরা পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীদের হত্যা করে ফেলেছি। এবার আসমানবাসীকে হত্যা করার পালা।
এরপর তারা আসমানের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে ওই তীরগুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে তাদের কাছে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসবে। তখন নির্বোধ লোকেরা মনে করবে, এবার আসমানের অধিবাসীরাও শেষ হয়ে গেছে।
এরপর প্রায় সাত বছর পবিতে শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। ভূপৃষ্ঠ তার সমস্ত বরকত উদগীরণ করে দিবে। তখন কেউ অভাবে থাকবে না এবং কেউ কাউকে কষ্ট দিবে না, কারো সাথে কেউ প্রতারণা করবে না। সর্বত্রই সাম্য ও সুুখ-শান্তি বিরাজ করবে। (সহীহুল বুখারীঃ হা-৪৭৪১)