মানব অন্তরের ভিতর আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও আবেগ বলতে যদি কিছু থাকে- তাহলে এই আন্তরিকতা ও ভালোবাসার হকদার সেই হতে পারে- যার অবদান তার উপর সর্বাধিক হয়। এটা তুলনামুলক স্তরভিত্তিক হতেও পারে। ঈমানের সূত্রে সবার আগে আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাভাবিকভাবেই সবার আগে এর হকদার।
বিশ্ববাসীর প্রতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবদান কী? তাঁর অবদানের চেয়ে অধিক অবদান কি অন্য কারো আছে? নিশ্চয়ই কখনোই নয়। তিনি এই পৃথিবীকে কী দিয়েছেন? তিনি যা দিয়েছেন- এর সমকক্ষ অন্য কেউ দেয়নি, দিতেও পারেনি। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাও তাঁকে মুহাব্বাত করেন। এর ঘোষণা তিনি দিয়েছেন। তাঁর প্রতি মুহাব্বাতকে ঈমানের অংশ বলে ঘোষণা করেছেন।
এই পৃথিবীতে নবীকে সবচেয়ে ভালোবেসেছেন সাহাবায়ে কেরাম। নবীর প্রতি তাঁদের ভালোবাসার অসংখ্য ফিরিস্তি ইতিহাসের পাতায় ভরে রয়েছে। নবীর সাহাবীদের একেকজনের নবীর প্রতি ভালোবাসার কাহিনী যেনো একেকটি উপাখ্যান। এর কোনো তুলনা হয় না। সাহাবীরা তো আছেনই; সাহাবীদের পর তাবেয়ীন থেকে শুরু করে এরপরে উম্মতের মধ্যে এমন কিছু নবীপাগল রয়েছেন- নবীর প্রতি যাদের ভালোবাসা-মুহাব্বাতের নমুনা অভাবনীয়। মরা আত্মাকে জীবন্ত করে তুলতে এরকম একটি ঘটনাই যথেষ্ট।
শায়খুল হাদীস যাকারিয়া মুহাজিরে মাদানী রহ. এরকমই একটি ঘটনা বর্ণনা করেন-
শায়খ আল্লামা জামী রহ. প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে আবেগভরা মাধুর্য্যময় ও আন্তরিক মুহাব্বাত প্রদর্শনপূর্বক একটি কবিতা রচনা করেন। একবার তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে গমণকালে মনে মনে এ সিদ্ধান্ত নেন যে, হজ্জ আদায় করার পর মদীনা মুনাওয়ারায় গিয়ে নবীয়ে পাকের রওযায় দাঁড়িয়ে এই কবিতা আবৃত্তি করবেন।
যথারীতি তিনি হজ্জ আদায় করার পর যখন মদীনা মুনাওয়ারায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন- তখন মক্কা মুকাররামাহ্র গভর্ণরকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নে বলে দেন- জামীকে আমার মদীনায় আসতে দিও না। মক্কার গভর্ণর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে সকালেই শায়খ জামীকে এ কথা জানিয়ে দেন। কিন্তু নবীপাগল জামী নবীর ভালোবাসায় এতোই আচ্ছন্ন ছিলেন যে, তিনি চুপিচুপি মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।
পরদিন আবার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার গভর্ণরকে স্বপ্নে এ ব্যাপারে সতর্ক করেন যে, জামী তো মদীনার দিকে রওয়ানা হয়ে গেছে। তাঁকে আসতে দিও না। মক্কার গভর্ণর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়েই শায়খ জামীকে মদীনা মুনাওয়ারার পথ থেকে গ্রেফতার করে তাঁর সাথে কঠোর আচরণ করেন, এরপর তাঁকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন।
কিন্তু তৃতীয় রাত্রের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার গভর্ণরকে স্বপ্নে আবার দেখা দেন। তিনি বললেন- হায় গভর্ণর! তুমি এ কি করলে! সে তো অপরাধী নয়। তুমি তাঁকে বন্দী করেছো কেনো? আমি তাঁকে এজন্য মদীনায় আসতে নিষেধ করেছি যে, সে আমাকে উদ্দেশ্য করে একটি কবিতা রচনা করেছে।
উক্ত কবিতা সে মদীনায় এসে আমার কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা করেছে। শোনো হে গভর্ণর! যদি জামী আমার কবরের পার্শ্বে এসে এ কবিতা আবৃত্তি করা শুরু করে- তাহলে আমার কবরের উপরিভাগ ফেটে গিয়ে আমার হাত তাঁর সাথে মুসাফাহা করার জন্য বের হয়ে আসবে। এ কথা শোনে মক্কার গভর্ণর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সাথে সাথে তিনি জামীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁকে আন্তরিক অভিবাদন জানান। তাঁর সাথে অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করছি-
বিশ্ববরেণ্য ইমাম মিসরের অধিবাসী শায়খ আবু আব্দুল্লাহ শরফুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে সাঈদ বুসীরী রহ. এক সময় পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েন। ফলে বিছানাই তাঁর আশ্রয়স্থল হয়ে যায়। বহু চিকিৎসা করেও কোনো সুফল পাননি। আরোগ্য লাভে তিনি ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে একটি কাসীদাহ রচনা করেন এবং এর ওসীলায় তিনি আল্লাহ তা’আলার দরবারে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করার নিয়ত করেন।
কাসীদাহ রচনা সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি এক জুমু’আর রাতে পাক-পবিত্র হয়ে এক নির্জন ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে গভীর মনোযোগে পরম ভক্তিসহকারে উক্ত কাসীদাহ আবৃত্তি করতে থাকেন। কাসীদাহ আবৃত্তি করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি স্বপ্নে দেখেন- তাঁর ঘরটি পুরোপুরি আলোকে উদ্ভাসিত হযে গেছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘরে তাশরীফ এনেছেন। এ অবস্থায়ই ইমাম বুসিরী রহ. আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন এবং স্বপ্নাবস্থায়ই তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাসীদাহ আবৃত্তি করে শুনাতে থাকেন। আবৃত্তি করতে করতে যখন তিনি কাসীদাহ-এর শেষের দিকে একটি পংক্তি পর্যন্ত পৌঁছেন- যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে-
“কাম আবরাআত আসিবান”- অর্থঃ কত রুগ্ন ব্যক্তিকে নিরাময় করেছে প্রিয় নবীর পবিত্র হাতের স্পর্শ, তখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় হাত মুবারক দিয়ে ইমাম বুসিরীর সমগ্র দেহ মুছে দেন এবং তিনি খুশী হয়ে নিজ শরীরের নকশাযুক্ত ইয়ামানী চাদর দ্বারা ইমাম বুসিরীকে ঢেকে দেন। এরপর ইমাম বুসিরীর স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখতে পান- প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, ইমাম বুসিরী সম্পূর্ণ রোগমুক্ত এবং বাস্তবেই নবীজির ইয়ামানী চাদর তাঁর গায়ে জড়ানো। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায় করলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমাম বুসিরী রহ. বাজারের দিকে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে এক বুযুর্গ ব্যক্তির সাথে দেখা হলো। বুযুর্গ ব্যক্তি ইমাম বুসিরীকে বললেন- আপনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে যে কাসীদাহ রচনা করেছেন- তা আমাকে একটু শুনান। ইমাম বুসিরী বললেন- আমি এ বিষয়ে অনেক কবিতা লিখেছি, আপনি কোনটি শুনতে চান। তখন ওই বুযুর্গ ব্যক্তি গতরাতে নবীকে শোনানো কাসীদাহ-এর প্রথম চরণটি আবৃত্তি করে বললেন- এটাই শুনান।
ইমাম বুসিরী বুযুর্গের কথা শোনে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন- আপনি এ কাসীদাহ কোথায় পেলেন? আমি তো এখনো এ কাসীদাহ অন্য কারো সামনে প্রকাশ করিনি। বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন- গতরাতে যখন আপনি এ কাসীদাহ নবীকে আবৃত্তি করে শুনাচ্ছিলেন- তখন আমি সেখানে উপস্থিত থেকে তা শুনছিলাম। শুধু আমি নই, কারণ আল্লাহ তা’আলা তখনই এ কাসীদাহ তাঁর বিশেষ বান্দাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহু আকবার! কখনো কি ভাবা যায় যে, ভালোবাসা কোন পর্যায়ে থাকলে স্বয়ং নবীজি স্বপ্নাবস্থায় এসে ধরা দেন।
ইমাম বুসিরীর উক্ত কাসীদাহ ইতিহাসের পাতায় “কাসীদায়ে বুরদাহ” নামে পরিচিত।