ফতোয়া ফিকাহ শাস্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য পরিভাষা। যার অর্থ- উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে শরীয়ত প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে ফয়সালা প্রদান করা।
কুরআনে ফতোয়ার কথা
ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা কিংবা ফতোয়া প্রদান করা সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নয়; বরং এটা ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। এই ফতোয়ার সূচনা ঘটে সর্বপ্রথম স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।
ইসলামের আগে জাহেলী যুগে নারী ও শিশুদেরকে সম্পত্তির অংশ দেওয়া হতো না। কারণ যুদ্ধ বা সংগ্রামে তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। ইসলাম আবির্ভাবের পর যখন নারী ও শিশুদেরকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঘোষণা দিয়ে কুরআনে আয়াত নাযিল হলো, তখন সাহাবীগণ কিছুটা বিব্রত হয়ে বিষয়টা আরো পরিস্কার করে বুঝার জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরনাপন্ন হয়ে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করলেন। সেই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন; ইরশাদ হলো-
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِن لَّمْ يَكُن لَّهَا وَلَدٌ فَإِن كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِن كَانُوا إِخْوَةً رِّجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ أَن تَضِلُّوا وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ-
অর্থঃ মানুষ আপনার নিকট ফতোয়া জিজ্ঞাসা করছে। অতএব আপনি বলে দিন- আল্লাহ তোমাদেরকে কালালাহ-এর মীরাস সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশ বাতলে দিচ্ছেন। যদি কোনো পুরুষ মারা যায় এবং তার কোনো সন্তানাদি না থাকে এবং এক বোন থাকে, তবে সে পাবে তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তির অর্ধেক অংশ এবং সে যদি নিঃসন্তান হয়, তবে তার ভাই তার উত্তরাধিকারী হবে। তার দুই বোন থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ।
পক্ষান্তরে যদি ভাই ও বোন উভয়ই থাকে, তবে একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর সমান। তোমরা বিভ্রান্ত হবে বলে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন। আর আল্লাহ তা’আলা হচ্ছেন সর্ব বিষয়ে পরিজ্ঞাত। (সূরা নিসা-১৭৬)
নববী ও সাহাবা যুগে ফতোয়া
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র যামানায় যখনি কোনো বিষয়ে জটিল সমস্যা দেখা দিতো, তখন সাহাবীগণ তাঁর কাছে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করতেন। তখন নবীজি আল্লাহ তা’আলার প্রতিনিধিত্ব করে ফতোয়া প্রদান করতেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পরে তাঁর আলিম ও মুফতী সাহাবীগণ তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে ফতোয়া প্রদান করতেন। ইসলামি খিলাফতের অধীনে বিভিন্ন প্রদেশে একেক সাহাবী ফতোয়া প্রদানের জন্য নিয়োজিত ছিলেন। যথা- কুফার মুফতী ছিলেন- সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.।
সাহাবীগণের পরে তাঁদেরই শিষ্য তথা তাবেয়ীনগণ সে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁদের পরে তাঁদের শিষ্য তথা তাবে-তাবেয়ীনগণ ফতোয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন।
এভাবে যুগের পরস্পরায় ফতোয়া জিজ্ঞাসা এবং ফতোয়া প্রদান একটি ইসলামী শরীয়তের ধারাবহিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে উঠেছে। এ পৃথিবীতে ইসলাম ও ইসলামী উম্মাহর অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, ফকীহ-মুফতী ও ফতোয়ার কার্যকারিতাও ততদিন বিদ্যমান থাকবে।
সুতরাং ফতোয়া ইসলামী শরীয়তের অন্যতম সাংবিধানিক ভিত্তি। ফতোয়া না থাকলে ইসলামী সমাজ ও জীবন বিধান এক নিমিষে অচল হয়ে পড়বে। তাই ফতোয়া কখনোই বর্জনীয় বা পরিতাজ্য নয়; বরং ফতোয়ার অপপ্রয়োগ পরিতাজ্য ও বর্জনীয়।
ফতোয়া সংশ্লিষ্ট জরুরি কিছু পরিভাষা
বলাবাহুল্য, শরীয়তের বিশেষজ্ঞ আলিমকেই ইসলামী পরিভাসায় মুফতী কিংবা ফকীহ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
একজন ফকীহ কিংবা মুফতী কুরআন-সুন্নাহ থেকে সিদ্ধান্ত আহরণের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে সে গবেষণা করেন- তাকে ইজতিহাদ বলা হয়।
ইজতিহাদের পরে একজন মুফতী অথবা ফকীহ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন- তাকে ইফতা অথবা ফতোয়া প্রদান বলা হয়।
মানব জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে কোনো প্রয়োজন বা সমস্যার সমাধানকল্পে শরীয়তের বিধান জানার লক্ষ্যে কোনো ফকীহ অথবা মুফতীকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করাকে শরীয়তের পরিভাষায় ইসতিফতা বলে।
শরীয়ত বিশেষজ্ঞ মুফতী বা ফকীহর দেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসরণ করাকে তাকলীদ বলে।
ফতোয়া জিজ্ঞাসাকারীকে মুসতাফতী বলে। আর যিনি ফতোয়া প্রদান করেন- তাঁকে মুফতী বা ফকীহ বলে।
উম্মাহর জীবনে ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা
সাধারণভাবেই উম্মাহর সব মুসলিমের পক্ষে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর মতো বিশাল ভান্ডার থেকে সিদ্ধান্ত আহরণ করা অথবা নিজে নিজে বিধান অনুসন্ধান করে পালন করা সহজ না। এ কারণে শরীয়তে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে শরীয়তের বিধি-বিধান ও সিদ্ধান্ত জেনে সে অনুযায়ী আমল করা সাধারণ মুসলিমদের ওপর কর্তব্য। এটাও শরীয়তের বিধান। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির দেওয়া সিদ্ধান্তের আলোকে আমল করার অপর নাম হলো তাকলীদ। যা এর আগে আলোচিত হয়েছে।