কুরআনে শুধু আল্লাহ তা’আলার বিধান লিখে দেওয়া গ্রন্থই নয়; বরং এই গ্রন্থকে মানবজাতির পথনির্দেশনা বলা হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিধান ছাড়াও মানব জাতির জীবন ও জগত সম্পর্কিত সবকিছুর বর্ণনা এই কুরআনে দেওয়া হয়েছে।
বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ মূলনীতি অবলম্বন করা হয়েছে। যা কুরআনের আয়াত ও এর বর্ণনাভঙ্গি পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করার দ্বারা প্রতীয়মান হয়। এখানে কুরআনের আয়াতে বিধান বর্ণনা করার ধরণ উল্লেখ করছি-
এক. সুস্পষ্ট বিধান (মুহকাম)
যথা- কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
أقيموا الصلاة وآتوا الزكاة-
অর্থঃ তোমরা সালাত আদায় করো এবং যাকাত প্রদান করো। (সূরা বাকারা-৪৩)
উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে সালাত আদায় এবং যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব এখানে সালাত আদায় ও যাকাত প্রদানের বিধান সুস্পষ্ট।
দুই. অস্পষ্ট বিধান (মুশতাবিহাত)
যথা- কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ-
অর্থঃ নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া নামক পাহাড় দুটি আল্লাহ তা’আলার অন্যতম নিদর্শন। সুতরাং হজ্জ-উমরাহ আদায়কারীদের এ দুই পাহাড়ে সায়ী করতে কোনো সমস্যা নেই। (সূরা বাকারা-১৫৮)
উক্ত আয়াতে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করার বিধান অস্পষ্ট। কারণ এ সায়ী করা কি আবশ্যক না এর বিধান সাধারণ পর্যায়ে রাখা হয়েছে- তা পরিস্কার করা হয়নি।
তবে উরওয়া রাযি. কর্তৃক আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীসের আলোকে সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে। উরওয়া রাযি. এ প্রসঙ্গে আয়েশা রাযি.কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন- হে উরওয়া! তুমি বলতে চাচ্ছো, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করার বিধান সাধারণ পর্যায়ে; অর্থাৎ জায়েয, কিন্তু আবশ্যক নয়। প্রকৃতপক্ষে এমনটি নয়। কারণ এর বিধান সাধারণ পর্যায়ে হলে কুরআনে এভাবে ইরশাদ হতো-
সুতরাং হজ্জ-উমরাহ আদায়কারীদের এ দুই পাহাড়ে সায়ী না করলে কোনো সমস্যা নেই। অথচ এভাবে বলা হয়নি।
তিন. মূলনীতি সম্বলিত বিধান (উসুলি)
যথা- কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ-
অর্থঃ তাদের ওপর নিকৃষ্ট প্রাণি ভক্ষণ করা হারাম করা হলো। (সূরা আরাফ-১৫৭)
উক্ত আয়াতে নিকৃষ্ট প্রাণির গোশত খাওয়া হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু কোন কোন প্রাণি খাওয়া যাবে না- তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি; বরঞ্চ এখানে একটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ নিকৃষ্ট শ্রেণির প্রাণি হারাম করা হলো।
তাই ইসলামের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ হাদীসে দীর্ঘ অনুসন্ধান ও ইজতিহাদের আলোকে কোন কোন প্রাণি খাওয়া হারাম- তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
কুরআন-হাদীস থেকে ফিকাহ উদ্ভাবনের পদ্ধতি
কুরআন ও হাদীস থেকে ফিকাহ বা মাসআলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিম্নে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য করতে হবে। এরপর সে অনুযায়ী মাসআলা উদ্ভাবন করতে হয়।
১. শরীয়তের কোনো বিধান সম্পর্কে অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা দিলে সর্বপ্রথম দেখতে হয় কুরআনুল কারীমে। কুরআনের সরাসরি বর্ণনায় উক্ত বিধানটি পাওয়া গেলে তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এ পদ্ধতিকে সরাসরি সূত্র (صراحة النص ) বলা হয়।
২. কুরআনের সরাসরি বর্ণনায় উক্ত বিধানটি সরাসরি যদি পাওয়া না যায়; বরং বর্ণনাভঙ্গি কিংবা ইঙ্গিতের মাধ্যমে তা বোধগম্য হয়, তা হলে সে আলোকেই সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এ পদ্ধতিকে ইঙ্গিতবহ সূত্র (إشارة النص ) বলা হয়।
৩. বর্ণনাভঙ্গি কিংবা কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিতের মাধ্যমেও উক্ত বিধান সাব্যস্ত না হয়ে কুরআনের স্বাভাবিক বর্ণনার আলোকে যদি তা বোধগম্য হয়, তা হলে সে আলোকেই সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এ পদ্ধতিকে সাংকেতিক সূত্র (دلالة النص) বলা হয়।
৪. অপরদিকে কোনো বিষয়কে সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে কুরআনে যদি এমন কোনো বিষয় বর্ণিত হয়- যার অর্থ বোধগম্য হওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কোনো কিছুকে উহ্য মানতে হয় অতঃপর তারই আলোকে উক্ত বিষয়টি বোধগম্য হয়, তা হলে সে আলোকেই সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এ পদ্ধতিকে চাহিদা সম্বলিত সূত্র (اقتضاء النص) বলা হয়।
৫. কুরআন থেকে উপরোক্ত চার পদ্ধতির কোনোটিরই ভিত্তিতে কাঙ্খিত বিধান সাব্যস্ত না হলে এক্ষেত্রে হাদীস ও সুন্নাহ থেকে এ চার প্রক্রিয়ার কোনো এক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
৬. হাদীস ও সুন্নাহর মধ্যেও উপরোক্ত উপরোক্ত চার পদ্ধতির কোনোটিরই ভিত্তিতে কাঙ্খিত বিধান সাব্যস্ত না হলে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে, নবীজির মহান সাহাবায়ে কেরামের এ ব্যাপারে কোনো ইজমা তথা সর্বসম্মত মতামত রয়েছে কিনা। থাকলে সে আলোকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
৭. উক্ত ইজমাও পাওয়া না গেলে কুরআন-সুন্নাহর সামগ্রিক প্রমাণাদি সামনে রেখে কিয়াস ও ইজতিহাদের আলোকে ফয়সালা করতে হবে।