ভালোবাসার সম্পর্ক দিবসের সাথে নয়; এর সম্পর্ক মনের সাথে
ভালোবাসা মানব মনের একটা বিশেষ আবেগিক রূপ। মনের গহীনে ভালোবাসার এই দিকটি সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশরুপেই বিদ্যমান। আমাদের দৃষ্টির সামনে বিশাল এই জগতকে ভালোবাসার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ তা’আলা মানবকুলকে অকৃত্রিম ও সীমাহীন ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন এবং মানবজাতিকেই তিনি তাঁর সৃষ্টির সেরা মাখলুক হিসেবে মনোনীত করেছেন। আর এই জগতের সবকিছুকে তিনি মানবজাতির ওপর উদারভাবে ঢেলে দিয়েছেন। তাই সৃষ্টির শুরু থেকেই ভালোবাসার জয়গান।
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এতোই ভালোবাসেন যে, তাঁর প্রতি বিশ্বাসী অথবা অবিশ্বাসী সবাইকে তিনি প্রতিপালন করছেন। আবার যারা তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাঁর অনুগত হয়েছে- তাদের ভুল-ত্র“টি কিংবা নাফরমানী আসমান ও যমীনের ফাঁকা জায়গা ভরে গেলেও তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে সব ক্ষমা করে দেন। হাদীসে কুদসীতে তিনি ইরশাদ করেন-
لو بلغت ذنوبك عنان السماء فاستغفرتني- غفرت لك ولا أبالي-
তোমার পাপ আসমান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকলেও আমার কাছে যদি ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিবো। এতে আমি কোনো দ্বিধা করবো না।
তিনি আরো ইরশাদ করেন- ألا ! كل بني آدم خطاؤون- وخير الخطائين التوابون-
জেনে রাখো, আদমের প্রত্যেক সন্তান ভুল করে। আর যে ভুল করার পর তওবা করে ফিরে আসে, সে সর্বোত্তম ভুলকারী।
التائب من الذنب كمن لا ذنب له-
যে ভুল করার পর তওবা করে ফিরে আসলো, সে এমন হয়ে গেলো, যেনো তার কোনো ভুলই নেই।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর উম্মতের প্রতি সীমাহীন অনুরাগ ও ভালোবাসা দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে তিনি ইরশাদ করেন-
لقد جائكم رسول من أنفسكم عزيز عليه ما عنتم- حريص عليكم بالمؤمنين رؤوف رحيم-
তোমাদের নিকট তোমাদেরই পক্ষ থেকে এমন এক রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যে বিষয় বিপন্ন করে, তা তাঁর জন্য বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী। তিনি মুমনিগণের প্রতি পরম দয়ালু। (সূরা তাওবা-১২৭)
কিয়ামতের মাঠে সবাই যখন ‘ইয়া নফসী ইয়া নফসী’ করতে থাকবে, তখন তিনি চিৎকার করে কাঁদতে থাকবেন আর বলবেন- ‘ইয়া উম্মাতী ইয়া উম্মাতী’। মক্কা ও তায়েফের লোকেরা তাঁকে কতই না কষ্ট দিয়েছিলো এমনকি তাঁর সুমহান সুউচ্চ ও পবিত্র চরিত্রের প্রতি কালিমা লেপন করতেও তাদের বুক কাঁপেনি। এরপরও তিনি কখনোই তাঁর প্রিয় উম্মতের ওপর বদদো’আ করেননি।
হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ তা’আলা এই ভালোবাসাকে সৃষ্টি করার পর তা ভাগ করে মানবজাতির মনে স্থাপন করে দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ)
মানবের শ্রেণীভেদ অনুযায়ী এই ভালোবাসার ভিন্নতা নির্ণিত হয়। এই ভালোবাসার জন্যই মা তার সন্তানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও স্বীয় কোলে আগলে রাখে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য স্বীয় জীবনকে পার করে দেয়। বন্ধু-বান্ধব একে অপরকে কাছে টানে। হিংস্র প্রাণী তার বাচ্চাকে আশ্রয় দেয়। এই ভালোবাসা পরম করুণাময়ের দান। এটা তাঁর সৃষ্টি রহস্যের অন্তর্গত।
ভালোবাসার ধরণ-প্রকৃতি
ভালোবাসার প্রকৃতি দুই ধরণের হয়। প্রথমতঃ একটা হলো- মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ, অর্থাৎ মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিক মনোভাব এবং স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি প্রসন্ন ধারণা। প্রসন্ন ধারণা হলো আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর সম্মানিত রাসূল এবং ইসলাম ও ইসলামের বিধান-প্রতীক ও এর সংশ্লিষ্ট কারো প্রতি ভালোবাসা, পুরুষের প্রতি পুরুষের, নারীর প্রতি নারীর এবং পুরুষের প্রতি নারীর ও নারীর প্রতি নারীর ভালো জানা, ভালোবাসা। এসব ভালোবাসা মহান আল্লাহ তা’আলার বিশাল সৃষ্টি জগতের সৃষ্টি তত্ত্বের অন্তর্গত।
এই ভালোবাসার কয়েকটি স্তর রয়েছে। যথা-
— আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমানের খাতিরে ভালোবাসা। যা পূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য শর্ত।
— মা-বাবার প্রতি সন্তান ও সন্তানের প্রতি মা-বাবার এবং ভাইবোনের পারস্পরিক ভালোবাসা। যা মানবের সহজাত বিষয়।
— স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা। যা আল্লাহ তা’আলার বিশেষ নিয়ামত।
— বন্ধু-বান্ধবের পারস্পরিক ভালোবাসা। যা মানবের জীবনের অন্যতম প্রাণ ও চালিকাশক্তি।
— সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতি ও অন্যান্য প্রাণীকুলের প্রতি ভালোবাসা।
দ্বিতীয়তঃ পুরুষের প্রতি নারীর কিংবা নারীর প্রতি পুরুষের প্রতি এমন আকর্ষণ- যার মধ্যে অনৈতিক বা অবৈধ কামনা-বাসনা কাজ করে। এটা ভালোবাসার ছদ্মাবরণে একটা বিকৃত রূপ। যার আগাগোড়া সবখানে প্রতারণা ও ছলচাতুরী প্রতি মুহুর্তেই বিদ্যমান থাকে। কারণ এক্ষেত্রে ভালোবাসার জন্য যে মন লাগে, তার কোনো ভূমিকা থাকে না; বরং এখানে শুধুমাত্র জৈবিক কামনা মানব মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রাখে।
এই ভালোবাসার মধ্যে মানুষ তার জৈবিক চাহিদাকে সামনে নিয়ে আসে। অথচ ক্ষুধা ও নিদ্রার প্রয়োজনের মতো জৈবিক চাহিদাও মানবজাতির একটা সহজাত বিষয়। পেটে ক্ষুধা লাগলে যেমন খেতে হয় এবং বিশ্রামের প্রয়োজনে যেমন নিদ্রা যেতে হয়, ঠিক তেমনি শরীরের ক্ষুধা নিবারণের জন্য জৈবিক চাহিদা পুরণ করতে হয়। তবে তা বিধিবদ্ধভাবে হলে মানবের এই চাহিদাও পুরণ হয় আবার মানবের চরিত্র ও সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু মানবজাতির কেউ যখন তার জৈবিক চাহিদাকে অবৈধ পন্থায় পুরণের দিকে ধাবিত হয়, তখন মানবের চরিত্র কলুষিত হয়। সমাজের শৃংখলা ও ভারসাম্য হারিয়ে যায়। এর পরিণতিতে মানবীয় মূল্যবোধের চুড়ান্ত অধঃপতন ঘটে।
অপরূপ ভালোবাসার বিকৃত রূপ
প্রকৃতপক্ষে এটা কখনোই ভালোবাসা নয়; বরং এটা একটা মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধি জন্ডিস রোগের মতো। এই রোগ একবার হলে পুনরায় হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। অবৈধ ভালোবাসার অবস্থা ঠিক এমনই। এই ভালোবাসার রোগ যার মধ্যে প্রবেশ করে, সে একটা প্লাবন ঘটায়। সেই প্লাবনের বিপক্ষে সবাই ভেসে যায়, পাড়ি জমায় শুধু রোগী নিজেই। রোগী যখন একবার এই অবৈধ ভালোবাসার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়, তখন তার এই প্রবৃত্তি সময় সাপেক্ষে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তার বিবেকের ওপর বিস্মৃতির পর্দা পড়ে যায়। তখন সে আগের সব কথা ভুলে যায়। আগের ভালোবাসার পাড়ি জমানোর কথা ও ব্যক্তির কথা তার মন থেকে উধাও হয়ে যায়। এরপর এই রোগ তাকে নতুনের সন্ধানে অন্ধভাবে ধাবিত করতে থাকে। এটাই অবৈধ ভালোবাসার নামে মানসিক রোগীর নীতি ও ধর্ম। এভাবে তার ভিতরে ক্রমান্বয়ে আমানতদারি ও সততার পরাজয় ঘটে। ফলে সে সবার আস্থা হারিয়ে ফেলে।
পৃথিবীতে অবৈধ ভালোবাসার নামে এই রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। মনুষ্যত্বের পূর্ণ জীবনাচরণকে জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষ আপাত মধুর ইন্দ্রীয় তৃপ্তির মোহে ভোগবাদের জীবনকে গ্রহণ করেছে। দূঃখজনক হলেও সত্য যে, সমাজে এই অবৈধ ভালোবাসার মন-মানসিকতা ভাইরাসের মতো অনুপ্রবেশ করেছে। নগ্নতা-বেহায়াপনার প্রতিযোগিতামূলক সামাজিক ব্যবস্থা পশ্চিমা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে। সেখান থেকে এই মানবঘাতক রোগ মুসলিম সমাজেও ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মুসলিম যুবক ও তরুণের মনের বিক্ষিপ্ততার মূল কারণ একমাত্র এই রোগ। অথচ এই রোগকে সমূলে মূলোৎপাটনের জন্য মাথা ব্যথা কারো নেই। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক এবং বন্ধুত্বের মতো অনাবিল বন্ধন মুহুর্তেই ধংস হয়ে যাচ্ছে। এই ঘাতকরূপী মানসিক রোগকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মূল্যায়ন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আয়োজন করা হয়েছে।
ভ্যালেন্টাইন’স ডে কী?
২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ই ফেব্র“য়ারিতে রোমের ধর্মযাজক ভ্যালেন রাষ্ট্রীয় ঘোষণার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সমাজের অবিবাহিত তরুণ-তরুণীর মধ্যে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের গোপনে বিয়ে দেন। এই কারণে ভ্যালেনকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ফলে ওই সময়ের তরুণ-তরুণীরা উক্ত দিনকে ভালোবাসার দিন হিসেবে ভ্যালেনকে স্মরণ করে। পরবর্তীতে ফুল দিয়ে তারা এই দিনকে উদযাপন করে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ষোড়শ শতাব্দীতে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে ভালোবাসার দেবতা নামে খ্যাত কিউপিডের যৌন লালসা নিবৃত্তির মাধ্যমে এই অবৈধ ভালোবাসার উম্মেষ ঘটে। এরপর ১৮০০ খৃষ্টাব্দ থেকে রাজা কালেন্সির রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মাধ্যমে ১৪ ই ফেব্র“য়ারির দিনকে অবৈধ ভালোবাসার নামে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে।
মানবের সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ হলো তার চরিত্র। মানব জীবনে চলাফেরায়, কথাবার্তায়, কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে এবং চিন্তাধারায় যে মহৎভাব পরিলক্ষিত হয়, তাকেই চরিত্র বলা হয়। অপরদিকে যার আচরণে আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদ প্রাধান্য পায়, তাকে চরিত্রহীন বলে। আচরণবিধির প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধটুকুও হারিয়ে ফেলে। ফলে সে মনুষ্যত্বের অবস্থান থেকে পশুত্বের দিকে অধঃপতিত হয়।
চারিত্রিক সততার সাথে পবিত্রতার শর্তেই ব্যক্তি হয় চরিত্রবান। বর্তমান সমাজে সচ্চরিত্র আর দুশ্চরিত্রের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ ভেদাভেদ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। বাহ্যিক আকর্ষণেই তারা মোহিত হয়ে অন্ধ হয়ে আছে। এজন্য তারা অহরহ নীতি গর্হিত কাজ করতেও সংকোচ করছে না। পাপের অসংখ্য প্রলোভন মানুষকে অন্ধের মতো বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। সেরকমই একটা পাপ হলো প্রতি বছর ১৪ ই ফেব্র“য়ারির দিনকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপন করা।
আল্লাহ তা’আলা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাসী ও ভালোবাসা পোষণকারী কোনো মুসলমানই এই দিবস উদযাপন করতে পারে না। এছাড়া এটা একটা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ প্রকৃত ভালোবাসার সম্পর্ক মনের সাথে, দৈহিক আনন্দের সাথে নয়। আর ভালোবাসা থাকে প্রতি মুহুর্তে, শুধু নির্দিষ্ট কোনো দিবসে নয়।