পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পেছনে বিরাট একটি উদ্দেশ্য আছে। মহান স্রষ্টা তার পবিত্র বাণি আল কুরআনে সে কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য। (সূরা যারিয়াত)
ইবাদত শুধুই স্রষ্টার জন্য। তবে ইবাদতের ফল বান্দা এবং তার অন্যান্য সৃষ্টি ভোগ করে। ইবাদত আল্লাহর জন্য হলেও তাতে লাভ আসলে বান্দারই।
ইবাদতের মধ্যে দুটি প্রকার আমরা খুঁজে পাই। একটা হচ্ছে আল্লাহর হক। অপরটি বান্দার হক। দুটোই সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। কোনোটিই কম নয়।
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ আল্লাহর হক পূরণ করাকে ইবাদত মনে করে। বান্দার হক পূরণও যে স্রষ্টার ইবাদতের মধ্যে গণ্য সে কথা অনেকেই ভাবেন না।
কিন্তু কেয়ামতের দিন মানুষ বান্দার হকের কারণে আটকে যাবে। স্রষ্টা বান্দার হক ক্ষমা করবেন না। হক বঞ্চিত ব্যাক্তিকে অধিকার দিবেন। সেই কঠিন দিনে কেউ কি তার এক বিন্দু অধিকার ছাড়তে চাইবে?
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, পৃথিবীতে আল্লাহর হক পূরণের চেয়ে বান্দার হক পূরণ বেশি কষ্টের। আল্লাহর হক পূরণের যে সকল ইবাদত সেগুলোতে আনন্দ অনেক। তেমন কষ্ট করা লাগে না। আÍিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। মানুষ ধার্মিক বলে। অভ্যাসবশত মানুষ নিয়মিত এসব ইবাদত করতে পারে।
যত সব বিপত্তি বান্দার হকের বেলায়। এই ইবাদত করতে গিয়ে কখনো ছোট হতে হয়। কখনো নিজেকে বিসর্জন দিতে হয়। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আÍিক প্রশান্তির বদলে মনঃপীড়া লাগে। মানুষও স্বীকার করতে চায় না। অনেক কষ্ট করে এই ইবাদত করতে হয়।
এজন্য এই শ্রেণির ইবাদতের পুরষ্কারও আল্লাহর কাছে বেশি। তবে অনেক ধার্মিক ব্যাক্তিকে এই শ্রেণির ইবাদতে পিছিয়ে থাকতে দেখি। আমাদের সমাজে অনেক ধার্মিক মানুষ এমন আছেন যিনি হয়ত সবসময় সামনের কাতারে নামায পড়েন। সবাই তাকে আবেদ পরহেজগার হিসেবে জানে। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে তিনি তার ভাই বা বোনের স¤পত্তি আÍসাৎ করে রেখেছেন। অথবা কারো স¤পদ বা অর্থ আটকে রেখেছেন। তার ভালোমানুষির আড়ালে কী লুকিয়ে আছে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না।
যে মানূষ আল্লাহর ভয়ে তার ইবাদত করতে পারেন, আল্লাহর হক আদায় করতে পারেন, তিনি কেন বান্দার হক পূরণের বেলা পিছিয়ে থাকবেন। ধার্মিক হয়েও কেন মানূষের প্রাপ্য অধিকার না দেয়ার কারণে তাকে শাস্তি পেতে হবে?
এখানে আমি বলি সাহসের অভাব। কারণ বান্দার হক আদায় করতে সাহসের প্রয়োজন হয়। প্রথম প্রকারের ইবাদতের মত এই ইবাদত সবসময় প্রশান্তি দেয় না। তাই শুধু সাহস নয়, বরং আমি বলি দুঃসাহসের দরকার হয়।
দুঃসাহস নামক মহৎ গুণ তাকে বান্দার হক পূরণ করা থেকে পিছিয়ে রাখে । পাঠক অবাক হচ্ছেন। দুঃসাহস কি মহৎ গুণ হতে পারে? মহৎ গুণ বলতে আমরা বুঝি দানশীলতা, উদারতা, দয়া, সত্যবাদিতা ইত্যাদি।
অনেকের কাছে দুঃসাহস তো কোনো গুণ নয়। গুরুজনরা তো সবসময় বলেন, সাহস ভালো। দুঃসাহস ভালো না। দুঃসাহস মানুষকে অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে। সাহস যখন একটু বেড়ে দুঃসাহসে পরিণত হয় অপরাধী তখন অপরাধ করতে দ্বিধা করে না।
কিন্তু কখনো কখনো ভালো কাজ করতেও দুঃসাহস লাগে। একথা কি কখনো ভেবেছেন? বরং বেশিরভাগ ভালো কাজই দুঃসাহস ছাড়া হয় না। তাই দুঃসাহস অবশ্যই মহৎ গুণ।
বাংলা ভাষায় দুঃ উপসর্গের বেশিরভাগ অর্থ নেতিবাচক। দুঃসময়, দুশ্চরিত্র কিংবা দুর্বিপাক। তেমনি একটি শব্দ দুঃসাহস। কেউ মন্দ কিছু করলে আমরা এই শব্দ ব্যবহার করি। দেখেছ কী দুঃসাহস! কেমনে করল এমন গর্হিত কাজ।
তবে কিছু কিছু ভালো কাজ করতে যখন আমাদের সাহস হয় না তখন আমাদের দুঃসাহসের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন হয়। শুধু সাহস দিয়ে আমরা ভালোকাজ করতে পারি না। একমাত্র দুঃসাহসই আমাদের তখন সাহায্য করতে পারে।
আমার মনে যে কষ্ট দিয়েছিল, তাকে আমি ক্ষমা করতে পারছি না। হয়ত প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সেই সাধ্য নেই। ক্ষমার তো প্রশ্নই ওঠে না। তখন আমরা দগ্ধ হই ভেতরে ভেতরে। তার প্রতি বিদ্বেষ লালন করি সযতেœ। এভাবে সারাটি জীবন কেটে যায়।
সেই লোকটি হয়ত বুঝতেও পারে না যে আমি তার ওপর রেগে আছি। অথবা বোঝে ঠিকই। তারও হয়ত সাহসের অভাব। তাই সে ক্ষমা চাইতে পারে না। তার সাহসের অভাব বলে সে আÍমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আমার কাছে ছোট হতে চায় না। অথবা তার বিন্দুমাত্র সাহস নেই যেজন্য সে নিজের অপরাধটা স্বীকার পর্যন্ত করতে চায় না। তাই সে দূরেই থেকে যায়।
সেই লোকটি কখনো হয় আমাদের স্বজন বা বন্ধু। আপন ভাই-বোন বা প্রিয় মানুষ। অথবা আমাদের মা-বাবা কিংবা সন্তান। একটু দুঃসাহসের অভাব এই প্রিয় মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখে আমাদের কাছ থেকে জীবনভর। কখনো নানা প্রয়োজনে তাদের সাথে চলতে হয়। সামাজিক, আর্থিক কিংবা যে কোনো প্রয়োজনে তাদের সাথে স¤পর্ক রাখতে হয়। তখন মুখে কিছু বলা যায় না। কিন্তু কষ্টের ছাইচাপা আগুন জ্বলতে থাকে বুকের ভেতর। সে আগুনে জ্বলে পুড়ে আমরা ছারখার হতে থাকি। তবু তাদের ক্ষমা করার দুঃসাহস আমাদের হয় না। ব্যথার আগুনের কষ্ট সইতে পারি। কিন্তু দুঃসাহস দেখাতে পারি না।
অথচ এই দুঃসাহস আমাদের ব্যথা ভোলাতে পারে। প্রিয় মানুষদের আরো প্রিয় বানিয়ে দিতে পারে। অনেক কাছে নিয়ে আসতে পারে দূরে চলে যাওয়া মানুষদের।
এমন আরো ভাল কাজের দুঃসাহসের অভাব আছে আমাদের। কাউকে ভালোবাসার দুঃসাহস, অন্যের জন্য কোনো কিছু ত্যাগের দুঃসাহস, সত্য বলার দুঃসাহস…। এমন দুঃসাহসের অভাব ভীরু আর কাপুরুষ বানিয়ে রেখেছে আমাদের।
তাই এই দুঃসাহস অর্জন করা অনেক প্রয়োজন। পরকালে সুখের জীবন কামনে করলে এই দুঃসাহস অর্জন করা অনেক বেশি দরকার আমাদের।
লিখেছেন- নাজমুস সাকিব, সহকারি সম্পাদক- মাসিক নবধ্বনি