পৃথিবীতে অনেক আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে। তবে ভাষার জন্য আন্দোলন পৃথিবীতে একটিই হয়েছে। আর তা হলো আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলন। পৃথিবীর মধ্যে ভাষার জন্য আন্দোলনের ইতিহাস শুধুই আমাদের। তাই এই আন্দোলন অন্যসব আন্দোলনের চেয়ে আলাদা।
১৯৪৭ সন থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে বিভিন্ন পরিক্রমা অতিক্রম করে ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্র“য়ারিতে এর সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। অবশেষে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্থান করে নেয়। ২১ ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়।
ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘদিনের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতে মুসলিম জাতির জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে- তা নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হয় ১৯৪০ সনের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর থেকেই। তবে ভাষা আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৪৭ সনে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর। মুসলিম জাতির স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে- সে প্রশ্নে তৎকালীন মুসলিম লীগের আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগেই পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। ফলে বাংলা ভাষা আন্দোলনের গতিপথ অন্যদিকে মোড় নেয়। শুরু হয় নতুন ইতিহাসের।
বৃটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের কিছুদিন পর ১৯৪৭ সনের পহেলা সেপ্টেম্বর কতিপয় বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিস নামে একটা সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত সংস্থার পক্ষ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দূ’ শীর্ষক একটা পুস্তিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের মূল যাত্রা শুরু হয়। উক্ত পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন। তাঁরা হলেন- তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক আবুল মানসুর আহমদ। তাঁরা ওই পুস্তিকার মাধ্যমে নিম্নোক্ত দাবিগুলো পেশ করেন-
পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি। একটি বাংলা এবং অপরটি উর্দূ।
উপরোক্ত দাবিগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ এবং বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর মাঝে ব্যাপকভাবে আলোচনা ও বৈঠক শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং ফজলুল হক হলে এই নিয়ে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া তৎকালীন সরকারের প্রতি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষরসহ স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
তখন ১৯৪৭ সনেই একটা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহবায়ক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল হক ভুঁইয়াকে।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা
অতঃপর ১৯৪৮ সনের ৪ জানুয়ারি পূর্ব বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটা স্বতন্ত্র ছাত্রসংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই ছাত্রসংস্থা আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠন করা হয়। উক্ত পরিষদের আহবায়ক করা হয় তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে।
এ সময়ে পাকিস্তান গণপরিষদের এক অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি এবং উর্দূর পাশাপাশি বাংলা ভাষায়ও বক্তৃতা করার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর পাল্টে যায় ভাষা আন্দোলনের চিত্র। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সনের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। এটা ছিলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। এই হরতাল ব্যাপকভাবে সফল হয়।
পাকিস্তান থেকে ভাষা আন্দোলনের এই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশেও। এই আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে পিকেটিং করতে গিয়ে সেক্রেটারিয়েট গেইটে কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অলি আহাদ প্রমুখ গ্রেফতার হন। এছাড়া অধ্যাপক আবুল কাসম সহ আরো অনেকে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। এ তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পর সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে বিক্ষুদ্ধ জনতার ঢল নামে। কিছুক্ষণের মধ্যে সমগ্র এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তৎকালীন সময়ে সেক্রটারিয়েটের চারদিকে কোনো দেয়াল ছিলো না; শুধু ছিলো কাঁটাতারের বেড়া। তখন অনেকেই কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে উপস্থিত মন্ত্রী ও সচিবদের কাছ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে পদত্যাগ করবেন- এই মর্মে ওয়াদা দিতে বাধ্য করেন।
সেক্রেটারিয়েট অঞ্চলে এই অরাজকতা ১১ মার্চ থেকে লাগাতার ১৫ মার্চ পর্যন্ত চলতে থাকলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ভয় পেয়ে যান। কারণ এর কয়েকদিন পর অর্থাৎ ১৯ মার্চ পাকিস্তানের কায়েদে আযম জিন্নাহর ঢাকায় আগমন করার কথা ছিলো। তাই বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তুলে। ফলে নাজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে ১৫ মার্চ তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত অনুযায়ী ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে গ্রেফতার হওয়া সকল বন্দিকে মুক্তি দিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।
এরপর ১৯ মার্চে পাকিস্তানের কায়েদে আযম জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার এক পর্যায়ে এবং ২৪ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে কার্জন হলে বক্তৃতা করার সময় উর্দূ ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তার এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। বাঙালী তরুণদের ক্ষোভ বিস্ফারণে রূপ নেয়। রেসকোর্স ময়দানে কারা তাঁর ঘোষণার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে- তা তিনি বুঝতে না পারলেও কার্জন হলে কিছু তরুণ যখন তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। কারণ এই তরুণরাই কিছুদিন আগেই তাঁর আহবানে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তাই তিনি বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে চলে যান। পরদিন তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা সমর্থকদের প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকার কারণে আলোচনা ব্যর্থ হয়। এরপর ওই বছরেরই ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদে আযম জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে এরপর আর কোনো প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি।
১৯৪৯ সন থেকে ১৯৫১ সন পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতো। তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৪৯ সনে বাংলা ভাষায় উর্দূ অক্ষর প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আব্দুল গফুর একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন- যা পরবর্তী সপ্তাহে ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। অন্যান্য সংস্থাও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। ফলে তদানীন্তন সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।
১৪৪ ধারা জারি
ইতিমধ্যে কায়েদে আযম জিন্নাহর পর পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সনের জানুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দূ বলে পুনরায় ঘোষণা করার পর ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নেয়। বাংলার জনগণ একে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে। কারণ এই নাজিমুদ্দীনই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নিয়ে ১৯৪৮ সনের ১৫ মার্চ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। তার এই বিশ্বাসঘাতকতার সমুচিত জওয়াব দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ঘটিত হয়। উক্ত সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ২১ ফেব্র“য়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। তবে তৎকালীন সরকার এই কর্মসূচী বানচাল করার নিমিত্তে ২০ ফেব্র“য়ারি হঠাৎ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।
রক্তের দাগে ভাষার স্বীকৃতি
এর ফলে ওই দিনই সন্ধ্যাবেলায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক জরুরী সভা আহবান করা হয়। উক্ত সভায় করণীয় স্থির করার জন্য পরামর্শ চলে। যদিও অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ছিলেন, তবুও পরদিন ভোরবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনতার সভার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে বলে স্থির করা হয়।
পরদিন ভোরবেলায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নতুন করে সূচিত হয়। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দলে দলে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে হঠাৎ শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ। ঢাকার রাজপথে লুটিয়ে পড়তে থাকে আব্দুস সালাম, আব্দুল জাব্বার, আবুল বরকত, রফীক প্রমুখ তরুণ ছাত্রসহ নাম না জানা আরো অন্যান্যদের রক্তাক্ত দেহ। রাজপথ লাল হয়ে যায় ভাষা শহীদদের তাজা খুনে। এর মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায়ে প্রবেশ করে। চূড়ান্তভাবে ভাষা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বিজয় হয় আমাদের মাতৃভাষা বাংলার। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্র“য়ারি ঘোষিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
আব্দুল্লাহ আল মাসূম
নির্বাহী সম্পাদক- দ্বি মাসিক কলম কালি