পশ্চিমা সভ্যতা আমাদেরকে নতুন নতুন বিষয় শেখাচ্ছে। পরিবার থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পর্যন্ত তাদের বাতলে দেওয়া মত ও দেখানো পথই যেন আজকের পৃথিবীর গতিপথ। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক কিছুই তাদের ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাচ্ছে, সেই তাণ্ডবে আমরাও নিজেদের স্বকীয়তা ও ধর্মের কথা ভুলে ছন্নছাড়া হয়ে বেঁচে থাকছি পরগাছার মতো।
আধুনিক সভ্যতার মোড়কে আমরা চর্চা করছি এমন কিছু বিষয়, যা আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে অতল ধ্বংসের দিকে। এমনই একটি পাশ্চাত্য উপহার সব মায়ের জন্য, বিশ্ববাসীর জন্য ‘মা দিবস’।
মাকে সম্মান ও শ্রদ্ধার দাবি তো প্রতিটি মুহূর্তের জন্য, তবে কী কারণ ছিল এই একটি দিন নির্ধারণের?
যে সমাজে মা বাবাকে শেষ বয়সে ফেলে আসা হয় বৃদ্ধাশ্রমে, তারা আমাদেরকে সবক দিচ্ছে ‘মা দিবস’ এর। একটি দিন মায়ের জন্য মায়াকান্না কেঁদে তাকে ভুলে থাকে বাকি বছর। অকৃত্রিম মায়ের প্রতি এমন মেকি সম্মান দেখিয়ে আমরা কি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছি তাদের বুকের দহন? আমাদের দেশেও আজ গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম, আমাদের মানসিক ও নৈতিক অধঃপতনের নির্মম ও করুণ উদাহরণ।
ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য এবং অপার উদারতার অন্যতম নির্দশন হলো, মা-বাবা কাফের মুশরিক হলেও তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছে সন্তানদের প্রতি। মায়ের প্রতি অবাধ্যতা ও খারাপ ব্যবহারের প্রতিফল এতোই ভয়ানক যে, আল্লাহ পাক দুনিয়াতেই এর কঠিন পরিণতি শাস্তির সূচনা করেন। আর মৃত্যুর পর পরকালে তো রয়েছেই।
এ সমাজের চারপাশে আমরা অনেক ‘কুসন্তান’ দেখি, যারা তাদের মায়ের সঙ্গে নিত্যদিন অবহেলা আর বেয়াদবি করছে, চড়া গলার বকবক আর শরীরের ঝাকুনিতে থামিয়ে দেয় মায়ের স্নেহমাখা কণ্ঠস্বর, তবু মায়েরা তাদেরকে ভোলেন না, ভুলতে পারেন না। কারণ সন্তান হয়তো নরাধম, কিন্তু মা তো আর নির্মম হতে পারেন না। শৈশব থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত অনবরত আমরা পেয়ে যাই মায়ের মমতাময়ী মন আর তার সযতœ প্রতিপালন- এ জীবনসংসারে আল্লাহ পাকের কি অপার নিদর্শন।
মায়ের জন্য ভালোবাসা, এই একটি মাত্র বিষয়, আল্লাহ পাক যেখানে কোনোরকম ছাড় দেননি। মায়ের সঙ্গে নম্র ও বিনয়ী ব্যবহারের বিষয়টিকে তিনি মিলিয়ে রেখেছেন নিজের সঙ্গে। পবিত্র কুরআনে বারবার বলেছেন, তোমরা শিরক করো না আল্লাহর ব্যাপারে, আর মা বাবার অবাধ্য হয়ো না..।
শুধু কি তাই, বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন ভঙ্গিতে তিনি আমাদেরকে এ বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন। ‘আর আমি মানুষকে ওসিয়ত করছি, তারা যেন তাদের মা বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। তার মা তাকে কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে, তারপর কতো যন্ত্রনায় তাকে প্রসব করেছে.।’ (সূরা আহকাফ-১৫)
একজন মা দীর্ঘ কয়েক মাস তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। তারপর তাকে অসহনীয় যন্ত্রণা সয়ে জন্ম দান করেন। জন্মের পর তাকে কোলে করে দুধ পান করান। তার মুখে খাবার তুলে দেন যতদিন শিশুটি নিজে খেতে না পারে। রাতভর জেগে থাকেন নির্ঘুম ক্লান্ত চোখে। দিনভর চোখের আড়াল হলেই উৎকন্ঠায় থাকেন। সামান্য অসুখ-বিসুখে অনবরত চোখের পানি ফেলেন দুশ্চিন্তায়। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানের মঙ্গলের জন্য স্রষ্টা কাছে হাত পাতেন যে মা, আজকের এ যান্ত্রিকতায় খুব সহজেই কি তাকে ভুলে যাই আমরা? আমাদের অবাধ্যতায় যখন মায়ের চোখের পানি ছলছল করে, তখনই হয়তো আল্লাহ পাকের কঠিন আজাব নেমে আসতে পারে, এর একটু কি ভয় হয় না আমাদের?
অথচ ইসলাম! মায়ের কোনো ব্যবহার কিংবা কথায় সামান্য ‘আহ’ বা ‘উফ’ শব্দটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লাহ পাক নিজের ভাষায় এ শব্দ উল্লেখ করে সতর্ক করেছেন, ‘সাবধান! মা বাবার সামনে কখনো যেন উফ শব্দটিও মুখ থেকে বের না হয়। তাদেরকে তোমরা ধমক দিয়ো না। তাদের সঙ্গে নরম হয়ে কথা বলো। দয়া ও মায়ার ব্যবহার করো নিজের মা বাবার সঙ্গে। যতদিন তারা বেঁচে থাকেন, তাদের সেবায় নিমগ্ন থেকো আর তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য দুআ করো। (ভাব অনুবাদ, সূরা ইসরা-২৩,২৪)
জীবনের প্রতিটি পদে পদে আল্লাহ পাক এভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে মায়ের সঙ্গে আচার-আচরণ করতে হবে। শুধু কুরআনের ভাষায় বারংবার তাগিদ দিয়ে নয়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমেও বিষয়টির বাস্তব প্রতিফলন দেখিয়ে সজাগ করেছে ইসলাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা আর মা বাবার অবাধ্য হওয়া। (সহীহুল বুখারী)
আরেক হাদিসে তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহগুলোর অন্যতম হল, মানুষ নিজের মা বাবাকে গালি দেওয়া। সাহাবাগণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মানুষ আবার কীভাবে নিজের মা বাবাকে গালি দিতে পারে? তিনি বললেন, কেউ যদি অন্যের মা বাবাকে গালি দেয়, তবে ওই লোকটিও নিশ্চয়ই প্রতিউত্তরে এ লোকটির মা বাবাকে গালি দেবে। (সহীহুল বুখারী)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মা বাবার প্রতি ভালো ব্যবহারের শেষ সীমানা হল, তাদের যারা বন্ধু-বান্ধব ছিলেন, তাদেরকেও সম্মান করা, ভালোবাসা ও দয়া করা। (সহীহ মুসলিম)
ইমাম আহমদ এবং ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন, মুআবিয়া বিন জাহিমা আস সুলামি নামক সাহাবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে তার সঙ্গে জিহাদে যাওয়ার জন্য বারবার অনুমতি চাচ্ছিলেন। শেষবার রাসুল জানিয়ে দিলেন, ‘দূর হও! যাও, মায়ের কাছে (পদতলে) থাকো, ওখানেই তোমার জান্নাত’।
অন্যত্র আবু হুরাইরা রা. এর সূত্রে বুখারি ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদিসে থেকে স্পষ্ট হয়, বাবার সম্মানের চেয়ে মায়ের সম্মান ও শ্রদ্ধা তিনগুণ বেশি।
একদিন মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে রাসুলের বুকভাঙা কান্না দেখে অবাক নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। রাসুলের কান্ন্ায় তারাও কেঁদেছিলেন সেদিন। আর কোনোদিন কোথাও তাকে এভাবে কেউ কখনো আকুল হয়ে কাঁদতে দেখেনি, মায়ের জন্য আপ্লুত হয়ে তিনি সেদিন যেভাবে কেঁদেছিলেন। (সহীহ মুসলিম; মুসনাদে আহমাদ)
মায়ের প্রতি রাসুলের ভালোবাসা ও সদাচারের জন্য রাসুলের তাগিদ দেখে সাহাবায়ে কেরামও নিজেদের মায়ের প্রতি ছিলেন পরম বিনয়ী ও সদাচারী।
হযরত আবু হুরাইরা রা. যখনই কোথাও যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হতেন, বিনীত কণ্ঠে ডাক দিয়ে বলতেন, ‘মা আমার! আপনার জন্য সালাম! আল্লাহ পাক আপনাকে রহমত দিয়ে ঘিরে রাখুন যেভাবে আপনি আমাকে ছোটবেলায় লালন পালন করেছিলেন।’ তার মা তখন সাড়া দিয়ে বলতেন, ‘ছেলে আমার! আল্লাহ তোমাকেও রহমত দান করুন যেভাবে তুমি আমাকে এই বুড়ো বয়সে সেবাযতœ করছো।’
আরেক বিখ্যাত সাহাবি ইবনে মাসউদ রা. এর মা এক রাতে ঘুম ভেঙে পানি চাইলেন। হজরত ইবনে মাসউদ দৌড়ে পানি আনতে গেলেন। ততক্ষনে মা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। মা হয়তো বিরক্ত হবেন, সেজন্য তিনি আর মায়ের ঘুম ভাঙালেন না, আবার যে কোনো সময় ঘুম ভেঙে হয়তো পানি চাইবেন, তাই সারারাত পানি নিয়ে মায়ের কাছে দাড়িয়ে রাত কাটিয়ে দিলেন।
এমন অজস্র ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় ভরা, তবু আমরা উদাসীন এ পরম নেয়ামতের মূল্যায়ন থেকে। ইবনে আওন আল মুজনি একজন প্রসিদ্ধ আলেম ও বুজুর্গ। তার মা তাকে ডাকলেন, তিনিও সাড়া দিলেন ‘জি আসছি’ বলে, কিন্তু অনিচ্ছায় তার গলার আওয়াজ কেমন যেন চড়া হয়ে গেল। এ সামান্য আওয়াজ উঁচু হয়ে যাওয়ায় তিনি অনুতপ্ত হলেন আল্লাহ পাকের কাছে, দুজন গোলাম তিনি মুক্ত করে দিলেন এর কাফফারা হিসেবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, তিনটি বিষয় এমন রয়েছে, যেগুলো একটি না হলে অন্যটিও আল্লাহ পাক কবুল করেন না। এর মধ্যে তৃতীয়টি হল, আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞতা এবং মা বাবার প্রতি সদাচারণ করা। সুতরাং যে আল্লাহকে মানে কিন্তু তার মা বাবার সঙ্গে সদাচারণ করলো না, তার কোন ইবাদতই কবুল হয় না।’
এর চেয়েও ভয়ানক বিষয় হলো, হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন, জিবরাইল আ. ওই ব্যক্তির জন্য বদ দুআ করেছেন, যে তার বৃদ্ধ মা বাবাকে পেয়েও তাদের সেবা যতœ করে নিজের জান্নাত অর্জন করে নিতে পারলো না। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুআয় আমিন বলেছেন। (বায়হাকী) ভাবা যায়! কত বড় সাংঘাতিক অভিশাপ তেড়ে আসে শুধু মা বাবার সেবাকে তুচ্ছ করার কারণে?
তাই, যাদের মা বেঁচে আছেন, তবুও প্রতিজ্ঞা হোক, আর নয় কোনো অবহেলা কিংবা কখনো অবাধ্য আচরণ! মায়ের সন্তুষ্টি অর্জনে উৎসর্গিত হোক আমাদের প্রতিটি প্রহর। মায়ের মায়াবী মুখ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার। এ বিশ্বাসে নবায়িত হোক আমাদের সব আচার ব্যবহার।