মানবীয় আবেগের সস্তা ব্যবহার
প্রচলিত কিছু বইয়ে কুরআন-হাদীসের সহীহ সনদবিহীন অনেক অতিরঞ্জিত কথা লেখা রয়েছে। কোনো কোনো বইয়ে বিশেষ বিশেষ নিয়মে নামায আদায় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, অনেক সময় হয়তো কোনো আমল বিশেষভাবে কোনো বুযুর্গ বা আউলিয়ায়ে কেরাম করে থাকেন। তাঁরা সেসব আমলের কথা লোকদের সামনে তুলে ধরেছেন- যা পরবর্তীতে কোনো বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আর একে পুঁজি করে এক শ্রেণীর লেখক, ব্যবসায়ী মানুষকে প্রতারিত করে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে এ জাতীয় বই প্রকাশ ও বিক্রয় করে যাচ্ছে।
শুধুমাত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বর্ণিত ও নবীর সাহাবীদের থেকে সহীহ সুত্রে কথা কিংবা কার্যের মাধ্যমে প্রমাণিত আমলই বৈধ ও শরীয়ত সম্মত। এছাড়া কারো ব্যক্তিগত বা সরাসরি উম্মতকে ব্যাপকভাবে করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়নি- এ জাতীয় কোনো আমল নিয়ে লিপ্ত হয়ে পড়া বা এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি ছাড়া আর কিছু নয়।
রবীউস সানী মাসে “ফাতিহা ইয়াযদাহম” নামে একটি অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। বলা হয়ে থাকে- ওই দিন নাকি শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী ইন্তিকাল করেছিলেন, তাই তাঁর রূহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে ‘ফাতিহা ইয়াযদাহম’ উদযাপন করা হয়।
কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ্যণীয়
এখানে কয়েকটি বিষয় আমাদের জন্য লক্ষ্যণীয়। যথা-
ইসলামী শরীয়তে “ফাতিহা ইয়াযদাহম” নামে স্বতন্ত্র কোনো ইবাদত, আমল কিংবা কোনো অনুষ্ঠানের কথা নেই। কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রচলিত এ অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
ইসলাম কোনো অনুষ্ঠান সর্বস্ব কিংবা দিবস উদযাপনের ধর্ম নয় যে, কতগুলো অনুষ্ঠান উদযাপন ও দিবস পালন করলেই ইসলাম অনুসরণ হয়ে গেলো। বরং সহজ কথায় ইসলাম একটি সার্বিক জীবনব্যবস্থার নাম- যা একমাত্র মানবকে কেন্দ্র করেই নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ একজন মানবের ব্যক্তিগত অবস্থা থেকে শুরু করে বাহ্যিক-আভ্যন্তরীণ, প্রকাশ্য-গোপনীয়, পারিবারিক ও সামাজিক জগত, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে কিংবা পর্যায়ে যত অবস্থা ও প্রয়োজন কিংবা চাহিদা রয়েছে- এগুলোর প্রত্যেকটির সমাধান এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর সম্মানিত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিধান এবং পদ্ধতির সমন্বিত নাম হচ্ছে ইসলাম।
অপরদিকে কোনো অনুষ্ঠান উদযাপন করা, অনুষ্ঠানের উপর সবকিছু সমাপ্ত করে দেওয়া কিংবা কোনো একটি উদ্দেশ্যকে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে এর জন্য একটি প্রতিপাদ্য বা স্লোগান বানিয়ে শুধুমাত্র ওই নির্দিষ্ট দিনেই ওই উদ্দেশ্যকে নিয়ে মাতামাতি করে দিবস উদযাপন করার পর বছরের অন্যান্য দিনে উক্ত উদ্দেশ্য থেকে উদাসীন হয়ে যাওয়া মেকি কার্যকালাপ ছাড়া আর কিছু নয়। পৃথিবীর অথবা মানবের কোনো উন্নতি কিংবা সমাধান এর মধ্যে নেই। এজন্যই ইসলাম এ ব্যাপারে কখনো উৎসাহিত নয়। শুধুমাত্র অনুষ্ঠান কিংবা দিবস উদযাপন সর্বস্ব কোনো বিধি-বিধান ইসলামে নেই। ইসলামের শিক্ষা হলো মানবজীবন সংশ্লিষ্ট কোনো প্রয়োজন কিংবা যে চাহিদা রয়েছে- তার সমাধান ও এ সম্পর্কিত বিধি-বিধানের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা বছরের প্রতিটি দিন কিংবা প্রতিটি মূহুর্তেই বিদ্যমান থাকুক।
ইসলামী শরীয়তের মৌলিক নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী পালন বা এর নামে কোনো অনুষ্ঠান উদযাপন করা অথবা ওরশ করার কোনো বৈধতা নেই। মোটকথা, শরীয়তে এর কোনো অস্তিত্বই নেই।
পৃথিবীর মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন নবী ও রাসুল আলাইহিমুস সালাম। আবার সমস্ত নবী ও রাসুল আলাইহিমুস সালামের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । অন্যান্য নবী ও রাসুল তো বটে, স্বয়ং আমাদের নবী শেষ নবী আল্লাহ তা’আলার পরে মানবকুলের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুণ্যময় কর্মবহুল জীবনের স্মরণীয় কোনো ঘটনা কিংবা মূহুর্ত এবং তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর কথা ইসলামে নেই। এর জন্য হুকুম তো দূরের কথা, কোনো উৎসাহও প্রদান করা হয়নি। কোনো ফযীলতের কথাও কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়নি।
নবী ও রাসূল আলাইহিমুস সালামের পর মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাঁদের মর্যাদা নবী ও রাসুলগণের পরে অন্যান্য মানব সদস্যদের থেকে সবার উপরে। একজন সাধারণ মানুষ মর্যাদাগত নিম্নস্তরের কোনো একজন সাহাবীরও সমতুল্য নয়। আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবী ছিলেন। এদের কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের অস্তিত্ব ইতিহাসের পাতায় নেই। যেখানে কোনো নবী বা রাসুলের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর কথা নেই- সেখানে প্রিয় নবীর সাহাবীদের কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর কথাই আসতে পারে না- এ ব্যাপারটি সহজেই বোধগম্য।
সুতরাং উপরোক্ত দুই শ্রেণী অর্থাৎ নবী-রাসুল আলাইহিমুস সালাম এবং সাহাবায়ে কেরামের পর মানবজাতির অন্যান্য সদস্য চাই সে কোনো বুযুর্গ বা মহা মনীষী হোক কিংবা সাধারণ স্তরের কোনো লোকই হোক না কেনো- কারো জন্ম বা মৃত্যু অথবা তার জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা বা মূহুর্তকে কেন্দ্র করে দিবস উদযাপন করা, ওরশ করা অথবা কোনো উৎসব পালন করা সবই ইসলাম বিরোধী ও শরীয়ত বহির্ভুত কার্যকালাপের আওতাভুক্ত। যেখানে কোনো নবী বা রাসুলের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর কথা নেই এবং প্রিয় নবীর সাহাবীদের কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর কথাও নেই, সেক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের পর মানবজাতির অন্যান্য সদস্য চাই সে কোনো বুযুর্গ বা মহা মনীষী হোক কিংবা সাধারণ স্তরের কোনো লোকই হোক না কেনো, তার জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর কথা যে আসতে পারে না- এ ব্যাপারটিও সহজেই বোধগম্য।
উপরোক্ত আলোচনা ও নির্দেশনার আলোকে শায়খ আব্দুল কাদির জিলানীর ইন্তিকালের দিনকে “ফাতিহা ইয়াযদাহম” নামে উদযাপন করার কোনো বৈধতা নেই। শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী নিঃসন্দেহে বুযুর্গ ছিলেন বটে, কিন্তু কারো ব্যক্তিগত অবস্থান কিংবা মর্যাদা কখনোই শরীয়তের নীতিমালার উপরে নয়- যেমনটি উপরে আলোচিত হয়েছে।