বিশ্বের ৩৩ টি রাষ্ট্র নিয়ে ছিল তুর্কী জাতির নেতৃত্বাধীন মুসলিম কেন্দ্রীয় খেলাফত ব্যবস্থা। দীর্ঘ ৬০০ বছরের ইতিহাস ওসমানী খেলাফতের সোনালী যুগের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। ২০২৩ সালের পর তুরস্ক রাহুমুক্ত হলে,১০০ বছর ধরে বয়ে চলা গোলামী চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে এসব দেশ আবার একটি রাষ্ট্রসংঘ গড়ে তুলতে পারে। স্বতন্ত্র সত্তা ধরে রেখেই প্রতিরক্ষা, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, উন্নয়ন, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে সহযোগিতার আওতায় মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমন্বয়ক হওয়াও বিচিত্র নয় এই তুরস্কের। তখন ৩৩ টি শুধু নয়, মোট ৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্রই একটি ইসলামিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আগামীর তুরস্ক নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের পাশাপাশি দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের অনেক আশাবাদ। বর্তমানে বিশ্বের দশম অর্থনৈতিক শক্তি। অষ্টম সামরিক শক্তি। মানবতার কল্যাণ ও ত্রাণ কর্মকাণ্ডের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে ডিঙিয়ে এখন তুরস্ক নাম্বার ওয়ান। জাতীয় ঐক্য, মিশনারী স্পিরিট আর ওসমানী খিলাফতের সময়কার বিশ্ব নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনার প্রেরণা এখন তুর্কীদের জীবনী-শক্তি। দীর্ঘ ৭৩ বছর ইসলাম বিরোধীদের নিষ্পেষণ পার হয়ে ২৪ বছর ধরে এক পারে দু পারে করে সামনে এগুচ্ছে তুরস্ক।
৬০০ বছরের বেশী ইসলামের পতাকা হাতে সভা পৃথিবীর সবটুকু শাসন করে যারা দুনিয়ায় ন্যায়বিচার ও সুশাসনের নজির স্থাপন করেছিল, সে তুর্কী জাতি আবারও জেগেছে। নেতা রজব তাইয়েব এরদোগানের হাত ধরে তারা একটি নতুন পথের দিশা পেতে চলেছে। মানবজাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে, একটি সুন্দর পৃথিবীর।
খেলাফত পতনের সময় ইসলাম বিরোধী অক্ষশক্তি চরম অমানবিক তামাশা ও গোলামী চুক্তির মাধ্যমে তুর্কী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। সেসব অন্ধকার দূর করে করে তুর্কী নতুন প্রজন্মের ইসলামমুখী কাফেলা এগিয়েছে বহুদূর। এই জঘন্য চুক্তির মেয়াদও শেষ হওয়ার পথে। ইনশাআল্লাহ বিজয় সমাগত। আগামী ৩ বছর পর মুক্তি মিলবে তুরস্কের। এ চুক্তির বিষয়ে মাহদী গালিব কৃত গবেষণা নিবন্ধে দেখা যায় ।
ওসমানি সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটে ১৫২১ সালে। পুরো সাম্রাজ্যের আয়তন দাঁড়ায় ৩৪ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার প্রায়। ২৩টা বাংলাদেশের সমান। বিভিন্ন সময় আয়তন বাড়ে-কমে। শুরু থেকে শেষ অবধি হিসেব করলে গড় আয়তন হয়- ১.৮ মিলিয়ন (১৮ লক্ষ) বর্গ কিলোমিটার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ হয়। মিত্রশক্তি যুদ্ধে জিতে। মিত্রশক্তি হচ্ছে- সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য , ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হেরেছিল কেন্দ্রীয় শক্তি। এরা হচ্ছে- ওসমানি সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া।
মিত্রশক্তি ওসমানি সাম্রাজ্যকে জবাই করে। টুকরো টুকরো করে। বর্তমান তুরস্ক ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার (৭৮৩,৫৬২)। মানে, ১০ লক্ষ ১৬ হাজার (১,০১৬,৪৩৮) বর্গ কিলোমিটারের বেশি এলাকা আলাদা করা হয়। বানানো হয় নতুন নতুন রাষ্ট্র।
ওসমানিদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে লুজানের চুক্তি। এটি ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এর মূল ক্রীড়নক ছিল বৃটেন। এ চুক্তিকে ‘শতাব্দী চুক্তি’ বলা যায়। চুক্তির মূল পয়েন্ট পাঁচটি।
১. খেলাফত ধ্বংস
ওসমানি খেলাফত সমূলে শেষ করা হয়। এর উত্তরাধিকারীদের গুপ্তহত্যা করা হয়। নিখোঁজ করা হয়। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়, পাচার করা হয় পশ্চিমা নানা দেশে । মুসলিম উত্থানের টুঁটি চেপে ধরা হয়।
২. উগ্র সেকুলার রাষ্ট্র
ইসলামের গৌরব ওসমানী খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র তুর্কিকে হয় একটি সেকুলার রাষ্ট্র। ইসলাম চর্চা হয় প্রায় নিষিদ্ধ। আরবিতে আযান নিষিদ্ধ করা হয়। কামানের মুখে কোরআন রেখে উড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি ভাষাও বদলে যায়। আগে আরবি ও ফার্সির রীতি অনুসারে লেখালেখি হত। অক্ষর বা বর্ণমালাকে বলা হত আবজাদ। আরবি বর্ণমালার মত ছিল সেটি। একে ওসমানি ভাষাও বলা হয়। এসব বদলিয়ে ল্যাটিন অক্ষরে লেখালেখি আরম্ভ হয়। রাতারাতি একটি জাতি হয় অক্ষরজ্ঞানহীন। চিন্তা করুন, কাল সকাল থেকে যদি অফিসিয়াল ভাষা হয় চাইনিজ, আপনার অবস্থাটা কী হবে? সত্য রূপটা হচ্ছে, সেকুলারিজমের নামে জায়নিস্টদের সমস্ত ঝাল মেটানো হয় তুরস্কে। একটি সুমহান জাতিকে ফেলে দেয়া হয় পরিচয়হীনতার অন্ধকূপে।
৩. জ্বালানী উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা
তুর্কি জীবাশ্ম জ্বালানী বা খনিজ তেল উৎপাদন করতে পারবে না। না নিজের দেশে, না অন্য দেশে। দেখুন, বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পেট্রো-ডলারের দখলে। সৌদি, আমিরাত কুয়েতসহ গালফের দেশগুলো তেল বেঁচেই আঙুল ফুলে কলাগাছ। এখানে, তুর্কিকে পেট্রো-অর্থনীতি থেকে বোল্ড আউট করা হয়।
৪. বসফরাস প্রণালী
বসফরাস প্রণালীকে তুর্কির এখতিয়ার একেবারেই তুলে নেয়া হয়। সহজ ভাষায় প্রণালী হচ্ছে, দুই সমুদ্রের মধ্যকার শর্টকাট সংযোগ নৌপথ। ধরুন দুই দিকে দুটি সাগর। মাঝখানে একটা জমি। আপনি ওপারের সমুদ্রে যেতে চান। তাহলে আপনাকে পুরো জমিটা ঘুরে এপারে আসতে হবে। পেরোতে হবে হাজার হাজার কিলোমিটার। কিন্তু জমিটার মাঝ দিয়ে যদি একটা নৌপথ থাকে, তবে বিষয়টা সহজ হয়ে যায়। হাজার কিলোমিটার ঘুরতে হয় না। সময় বাঁচে। অর্থ সাশ্রয় হয়।

বসফরাস হচ্ছে এমনি এক প্রণালী। যা এশিয়া থেকে ইউরোপে যাবার সহজ রাস্তা। এখন চিন্তা করুন, কী পরিমাণ ব্যবসা ইউরোপ-এশিয়ায় হয়? কী পরিমাণ মাল বোঝাই জাহাজ চলাচল করে? এই জাহাজগুলোতে উঠানো টোল কী পরিমাণ হবে? ভৌগলিকভাবে তাহলে বসফরাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
লুজানের চুক্তিতে বসফরাস থেকে তুর্কির কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়। মানে যে যতই এ পথে ব্যবসা করুক, তুর্কি শুল্ক তুলতে পারবে না। ভাবুন, কতটা আর কত ভাবে তুর্কিকে পঙ্গু করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এ গোলামী চুক্তির মেয়াদ ফুরালে শুধু বসফরাস প্রণালী থেকেই তুরস্কের জিডিপির বিশাল সমৃদ্ধি অর্জিত হবে।
৫. হেজাজ নিয়ন্ত্রণ
আজকের সৌদিআরব কিন্তু আসল নাম না। এটা গোত্রবাদী সৌদবংশ অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি রাজবংশের সূচনা হয়। এর আগে মক্কা-মদিনা ওসমানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল কয়েক শতাব্দী। ওসমানি শাসকরা নিজেদের আরবের শাসক বলত না। বলত খাদেম বা সেবক। লুজান চুক্তি অনুসারে, ১৯২৩ এর পরে ১০০ বছর ওসমানিরা জাজিরাতুল আরবের দিকে প্রশাসনিক ভাবে অগ্রসর হতে পারবে না।

তুর্কিরা এখনো হজে গেলে একটা আলাদা মানচিত্র সাথে রাখে। বর্তমান শাসকরা ঐতিহ্যবাহী যেসব নিদর্শন ধ্বংস করেছে, তার ফলে রাসূল স. এবং সাহাবিদের স্মৃতি বিজড়িত জায়গা ও অনেকের বাড়ি ঘরের অবস্থান কোনখানে তা বোঝা কষ্টকর। কিন্তু তুর্কিরা এসব জানে। কারণ তাদের মানচিত্রে সেসব চিহ্নিত আছে। কোন খলিফা, উম্মুল মুমিনীন, হজরত ফাতিমা, হজরত আব্বাস রা. সহ বিশিষ্ট সাহাবিদের মাকবারা কোনখানে, তাছাড়া কোন ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্য কোথায় ছিল,এসব দলিল তারা সবই সংরক্ষণ করে ।
তুর্কিরা এখনো কাবা শরিফের গিলাফ ধরে কান্না করে। বলে- ইয়া আল্লাহ্! আবার মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ফিরিয়ে দাও। ইসলামের খেলাফত পদ্ধতি ও বৈশ্বিক ঐক্য পুনরায় কায়েমের তাওফীক দাও।
আসুন, ধারণা করা যাক, ৩ বছর পর ২০২৩ সাল। মানে ১০০ বছরের চুক্তি শেষ হলো। এরপর কী হবে? তুর্কিরা কী করবে?
প্রথমেই তারা তেল উঠাবে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল ব্যবসার পাশে নতুন শক্তি হিসেবে তুরস্কের উত্থান ঘটবে। বসফরাস প্রণালী নিয়ন্ত্রণে নিবে। ইউরোপ- এশিয়ার বাণিজ্য চলাচলে ছড়ি ঘুরাবে। যা ইউরোপিয়দের জন্য অশনিসংকেত। তুর্কির অর্থনীতি এখনো ততটা বিশাল না। কিন্তু তেইশের পরে পরাশক্তির মতোই ফুলেফেঁপে উঠবে।
তুর্কিরা যেকোন মূল্যে সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। মার্কিন মুলুকের সাথে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় নামতে প্রস্তুত। চীন, রাশিয়া সহ মার্কিন বিরোধী প্রায় সমস্ত শক্তিগুলোর সাথে বর্তমান তুরস্কের কৌশলগত সখ্য। এমনকি পাকিস্তানের সাথেও তুর্কিদের জমজ ভাইয়ের সম্পর্ক।
শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তান ও তুরস্ক যৌথ বাহিনী ও নাগরিকত্বের ধারণাও অগ্রসর হচ্ছে। যদিও পাকিস্তান একমাত্র পারমানবিক শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্র। পাকিস্তান যার দিকে, শক্তির চাকা তার দিকে অনেকখানি ঘুরে যায়। ন্যাটো ও ইইউ এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ধাপগুলি এগিয়ে গেলে তুরস্ক পারমাণবিক শক্তি অর্জন এবং অস্ত্র তৈরির অনুমোদন বাগিয়ে নেবে। অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানিতে তুরস্ক এখন অনেক অগ্রসর।

আর আগামীতে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে ইসলাম। মুসলিমদেশগুলোর প্রতি তুর্কির আচরণগুলো খেয়াল করুন। বিশ্ব মুসলিমের প্রতিটি সংকট ও প্রয়োজনে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয় তুরস্ক। রোহিঙ্গা সহ নিপীড়িত মুসলিমদের সাহায্যে তারা এগিয়ে।
তুর্কি মুসলিমদের মাঝে শত বছর আগের সেই চেতনা ফেরাতে চাচ্ছে বর্তমান সরকার। ভবিষ্যৎ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বিশ্ব পরিস্থিতি বিচারে অনুমান করাও কঠিন। হয়ত গোলামী চুক্তির মেয়াদ শেষে তুর্কির মাধ্যমে ফিরতেও পারে মুসলিমদের সোনালী সময়।
লেখক: বিদগ্ধ আলেম, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, পাঠকপ্রিয় বহু গ্রন্থ প্রণেতা এবং চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালক, ঢাকা সেন্টার ফর দাওয়াহ এন্ড কালচার।