শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী
মাহে রজব সম্পর্কে জনমনে নানা ভ্রান্তি ও কুপ্রথা ছড়িয়ে আছে। এগুলোর হাকীকত ও স্বরূপ জানার প্রয়োজন রয়েছে।
মাহে রজবের দু’আ
বর্ণিত আছে যে, যখন মাহে রজব শুরু হলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দু’আ করতেন-
اللهم بارك لنا في رجب و شعبان- وبلغنا رمضان-
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও এবং আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। (মুসনাদে আহমাদ (যাওয়ায়েদ)ঃ ১/২৫৯, মুসনাদে বাযযার-মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ ২/১৬৫)
অর্থাৎ আমাদের হায়াত বৃদ্ধি করে দাও, যাতে আমরা রমযান লাভ করতে পারি, যেন বহু আগ থেকেই রমযানুল মুবারকের শুভাগমনের অধীর আগ্রহে থাকতেন। এই দু’আ ব্যতীত আরো যেসব বিষয় মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ আছে, শরীয়তে সেগুলোর কোন ভিত্তি নেই।
উপমাস্বরূপ, রজব মাসের ২৭ তারিখ সম্পর্কে এ কথা প্রসিদ্ধ যে, এটি শবে মে’রাজ। এ রাতও সেভাবেই কাটানো উচিত যেভাবে কদরের রাত কাটানো হয়। শবে কদরের যে ফযীলত শবে মে’রাজেরও কম ও বেশি সে ফযীলত মনে করা হয়, বরং এমনও মনে করা হয় যে, শবে মে’রাজের ফযীলত শবে কদরের চাইতেও বেশি।
তাছাড়া লোকেরা এ রাতে নামাজের বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি চালু করেছে যে, এ রাতে এক রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে এবং প্রতি রাকাতে অমুক অমুক নির্দিষ্ট সূরা পড়তে হবে। আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন! এই নামাজের ব্যাপারে মানুষের মাঝে কি কি নিয়ম ও শর্ত প্রসিদ্ধ আছে। ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা, শরীয়তে এগুলোর কোনো বুনিয়াদ নেই।
শবে মে’রাজের তারিখ সুনির্দিষ্ট নয়
সর্বপ্রথম কথা হলো যে, ২৭শে রজব সম্পর্কে নিশ্চিত বলা যায় না যে, এটাই সে রাত, যে রাতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মে’রাজে গমন করেছিলেন। কেননা এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে মে’রাজে গমন করেছিলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় রজব মাসের কথাও উল্লেখ আছে। আবার কোনো কোনো রেওয়ায়াতে অন্য মাসের কথাও এসেছে। কিন্তু উপরোক্ত রেওয়ায়াত সমূহের কোনটির বর্ণনাসূত্রই নির্ভরযোগ্য নয়। কাজেই দৃঢ়তার সাথে বলা যাচ্ছে না যে, সত্যিকার অর্থে মে’রাজ রজনী কোনটি। আর সুনির্দিষ্টভাবে ২৭শে রজব সম্পর্কে তো ইমাম ইবরাহীম হারবী রহ. ও ইমাম ইবনে রজব রহ. স্পষ্ট বলেছেন যে, এ রাত মে’রাজ হওয়ার কথাটি সঠিক নয়। (লাতায়েফুল মাআরেফঃ ১৩৪)
এ থেকে আপনি নিজেই আন্দাজ করে নিন যে, যদি শবে মে’রাজও শবে কদরের ন্যায় কোনো বিশেষ রাত হতো এবং শবে কদরের ন্যায় এ রাতেরও কোনো বিশেষ বিধানাবলী থাকতো, তাহলে শবে মে’রাজের তারিখ সংরক্ষণের প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হতো। তাই আমরা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো যে, এ রাতকে কেন্দ্র করে সমাজে যা কিছু প্রচলিত আছে, শরীয়তের দৃষ্টিতে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?
সে রাত মহিমান্বিত কিন্তু বিশেষ বিধানমুক্ত
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যে রাতে এই ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো, যে রাতে আল্লাহ তা’আলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিশেষ নৈকট্যের আসনে সমাসীন করেছিলেন, স্বীয় দরবারে উপস্থিতির সৌভাগ্য দান করেছিলেন এবং যে রাতে উম্মতের জন্য উপটোকন স্বরূপ নামাজ প্রদান করেছিলেন, নিশ্চয়ই সে রাত মহিমান্বিত। কোনো মুসলমানের সে রাতের মর্যাদা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু দেখার বিষয় হলো যে, হিজরতের আগে মে’রাজের এই ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এই ঘটনার পর তিনি কমপক্ষে এগারো বছরের বেশি জীবিত ছিলেন, কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ের ইতিহাসের কোথাও প্রমাণিত নয় যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শবে মে’রাজ সম্পর্কে কোনো বিশেষ বিধান দিয়েছেন অথবা এই রজনী উদযাপনে যতœবান হয়েছেন কিংবা এ সম্পর্কে বলেছেন যে, শবে কদরের ন্যায় এ রাতেও জাগ্রত থাকলে সাওয়াব হবে। এ ধরনের কোন বাণী তিনি ইরশাদ করেননি এবং নববী যুগে এ রাতে জাগ্রত থাকার বিষয়টিও প্রমাণিত নয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও জাগ্রত থাকেননি, সাহাবায়ে কেরামকেও জাগ্রত থাকতে বলেননি এবং সাহাবায়ে কেরামও নিজ থেকে এমনটি করেননি।
তাই যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, ২৭শে রজবই শবে মে’রাজ, তথাপি এ কথা সাব্যস্ত হয় না যে, এ রাতে আমাদের জন্য কোনো বিশেষ করণীয় কাজ রয়েছে বা এ রাতটিকে উদযাপন করা সম্পর্কে কোনো বিধান রয়েছে। কারণ যদি এমনটি হতো, তাহলে মে’রাজের পর এতো দীর্ঘ নববী জীবনে তার প্রমাণ পাওয়া যেতো। তাছাড়া আরো প্রমাণ পাওয়া যেতো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈদের জীবনীতেও।
দু’জাহানের সরদার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর একশত বছর পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরাম এই দুনিয়াতে বিদ্যমান ছিলেন। এই সুদীর্ঘ এক শতাব্দীতে এমন কোনো ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না যে, সাহাবায়ে কেরাম ২৭শে রজব উদযাপন করেছেন। সুতরাং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি এবং যা তাঁর সাহাবায়ে কেরামও করেননি, তাকে দ্বীনের অংশ মনে করা অথবা তাকে সুন্নাত সাব্যস্ত করা কিংবা তার সাথে সুন্নাতের ন্যায় আচরণ করা বিদ’আত তথা কুসংস্কারের শামিল। যদি কেউ এ কথা বলে যে, কোনো রাত ফযীলতপূর্ণ এ ব্যাপারে আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও বেশি জ্ঞান রাখি অথবা যদি কেউ এ কথা বলে যে, সাহাবায়ে কেরামের তুলনায় ইবাদতের আগ্রহ আমার বেশি। তাই সাহাবায়ে কেরাম যদি এ আমল নাও করে থাকেন আমি করবো- তাহলে তার মতো বড় নির্বোধ আর কেউ নেই।
আমার মুহতারাম পিতা মুফতী মুহাম্মাদ শফী সাহেব রহ. বলতেন- উর্দূ ভাষায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে, যা হিন্দুস্তানে খুব প্রসিদ্ধ ছিলো, কিন্তু এখন তো লোকেরা তার অর্থও বুঝে না। প্রবাদটি এই-
যে ব্যক্তি এ কথা বলে যে, আমি ব্যবসা-বাণিজ্যে বানিয়ার চাইতেও বেশি পারদর্শী এবং আমি ব্যবসায়িক গুঢ় তার চাইতে অধিক জানি- তাহলে মূলতঃ সে একজন পাগল। কেননা বানিয়ার চাইতে অধিক ব্যবসায়িক গুঢ় সম্পর্কে ধারণা কারো নেই। এটা তো হলো সাধারণ একটি প্রবাদ বাক্যের কথা। কিন্তু দ্বীনি ব্যাপারে একটি ধ্র“ব সত্য কথা এই যে, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন দ্বীন সম্পর্কে সব চাইতে অধিক জ্ঞান রাখতেন, তারা দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝেছেন এবং দ্বীন মোতাবেক পরিপূর্ণভাবে আমল করে গেছেন। এখন যদি কেউ এ কথা বলে যে, আমি দ্বীন সম্পর্কে তাদের চাইতে অধিক জ্ঞান রাখি, তাদের চাইতেও বেশি স্পৃহা রাখি অথবা তাদের চাইতে অধিক ইবাদত পালন করি- তাহলে বাস্তবে সেও একজন পাগল, তার দ্বীনের সঠিক ধারণা নেই।
শবে মে’রাজকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা বিদ’আত
কাজেই এ রাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা বা বিশেষ গুরুত্বারোপ করা বিদ’আত। আল্লাহ তা’আলা যদি প্রতি রাতে ইবাদতের তাওফীক দান করেন, তাহলে তো মঙ্গলই মঙ্গল। আজ রাতেও জাগ্রত থেকে ইবাদত করুন, আগামী কালও জাগ্রত থেকে ইবাদত করুন। এমনিভাবে ২৭শে রজবের রাতেও জাগ্রত থাকুন, উভয় রাতের মাঝে ব্যবধান না থাকা উচিত।
২৭শে রজবের রোজা প্রমাণিত নয়
অনুরূপ ২৭শে রজবের রোজা। কেউ কেউ ২৭শে রজবের রোজাকে ফযীলতপূর্ণ মনে করে থাকে। আশুরা ও আরাফার রোজা যেমন ফযীলতপূর্ণ, তেমনিভাবে ২৭শে রজবের রোজাকেও ফযীলতপূর্ণ জ্ঞান করে থাকে। আসল কথা এই যে, এ সম্পর্কে দু’একটি অত্যন্ত দুর্বল রেওয়ায়াত তো আছে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোনো রেওয়ায়াত নেই।
রজবের বিদ’আত প্রতিরোধে সাহাবী ওমর রাযি.
ফারুকে আযম রাযি.-এর যুগে কতিপয় লোক (বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে) রজবের রোজা রাখতে শুরু করেছিলো। যখন তাঁর নিকট সংবাদ পৌঁছলো যে, রজবের বিশেষ মর্যাদা স্বরূপ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কিছু মানুষ রোজা রাখছে। আর যেহেতু তাঁর এখানে দ্বীনের ব্যাপারে সামান্য এদিক ওদিক হওয়া সহনীয় ছিলো না, তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং একেকজনকে ধরে জোরপূর্বক বললেন- তোমরা আমার সামনে খাবার খাও এবং এ কথা প্রমাণ করো যে, তোমরা রোজাদার নও।
তিনি যথাযথ গুরুত্বের সাথে লোকদেরকে ধরে ধরে খাবার খাওয়ালেন, যাতে লোকেরা এরূপ ধারণা পোষণ করতে না পারে যে, এ মাসের রোজার ফযীলত বেশি। বরং অন্যান্য মাসে যেরূপ নফল রোজা রাখা যায়, তদ্রুপ এ মাসেও নফল রোজা রাখা যায়। উভয়ের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। ফারূকে আযম রাযি. গুরুত্বের সাথে এমনটি করেছেন, যাতে বিদ’আতের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এবং নিজেদের পক্ষ থেকে দ্বীনের ব্যাপারে নতুন কিছুর সংযোজন না ঘটে।
রাত জেগে কি গোনাহ করে ফেললাম?
উক্ত আলোচনা থেকে এ কথা বুঝা গেলো যে, কতিপয় লোক যারা এই ধারণা পোষণ করে যে, ‘যদি আমরা শবে মে’রাজে রাত জেগে ইবাদত করি এবং দিনের বেলায় রোজা রাখি, তাহলে আমরা কি কোনো গুনাহ করলাম? আমরা কি চুরি করেছি? অথবা মদ পান করেছি? কিংবা ডাকাতি করেছি? আমরা তো রাতে ইবাদতই করেছি। আর যদি দিনের বেলায় রোজা রাখি, তাহলেই বা কী খারাপ কাজ করলাম? তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক; যা একটু চিন্তা করলে আমরা ফারূকে আযম রাযি.-এর উক্ত ঘটনা থেকে উপলব্ধি করতে পারি। কারণ ফারূকে আযম রাযি. এ কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কোন শরয়ী দলীল ব্যতিরেকে নিজ থেকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করাই হলো সংকটের মূল কারণ।
আমি এ কথা বহুবার বলেছি যে, পুরো দ্বীনের সারাংশ হলো ইত্তিবা তথা অনুসরণ- আমরা (আল্লাহ তা’আলার) হুকুম পালন করো। রোজা রাখার মধ্যেও কিছু নেই, রোজা না রাখার মধ্যেও কিছু নেই। নামাজ আদায় করার মধ্যেও কিছুই নেই। যখন আমি বলবো নামাজ আদায় করো, তখন নামাজ আদায় করা ইবাদত। এবং যখন বলবো নামাজ আদায় করো না, তখন নামাজ আদায় না করাই ইবাদত। যখন আমি বলবো রোজা রাখো, তখন রোজা রাখা ইবাদত। যখন আমি বলবো রোজা রেখো না, তখন রোজা না রাখাই ইবাদত। যদি সে সময় রোজা রাখে, তাহলে তা দ্বীনের পরিপন্থী কাজ হবে। দ্বীনের সকল কাজ কারবার অনুসরণের আওতাভুক্ত। যদি আল্লাহ তা’আলা এই মূলতত্ত্বের বুঝ অন্তরে ঢেলে দেন, তাহলে সকল বিদ’আতের মূলোৎপাটন ঘটবে।
এখন যদি কোনো ব্যক্তি ২৭শে রজবের রোজার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করে, তাহলে সে নিজের পক্ষ থেকে দ্বীনের ব্যাপারে বৃদ্ধি সাধন করলো এবং নিজের পক্ষ থেকে দ্বীনি বিধান তৈরি করলো। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা রাখা না-জায়েয। অবশ্য যদি কেউ অন্যান্য দিনের ন্যায় এ তারিখেও রোজা রাখতে চায়, তাহলে রোজা রাখতে পারে, এতে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। কিন্তু এ তারিখের রোজাকে সুন্নাত ভেবে, অধিক মুস্তাহাব এবং অধিক সাওয়াবের কারণ মনে করে রোজা রাখা বিদ’আত।
অতএব সারমর্ম হলো, রজব মাস রমযান মাসের ভূমিকা স্বরূপ। তাই রমযানের জন্য নিজেকে শুরু থেকেই প্রস্তুত করার দরকার রয়েছে। নিজের সময়সূচীকে এমনভাবে বানানো দরকার, যাতে মুবারক মাস আসলেই অধিকতর সময় আল্লাহ তা’আলার ইবাদতে অতিবাহিত হয়।