এই পৃথিবী তিল তিল করে গড়ে উঠছে শ্রমিকের গায়ের ঘামে। চলাচলের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, দ্রুত গতির যানবাহন, মানবীয় খাবারের উপাদানে ভরে উঠা বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এবং বসবাসের জন্য নির্মিত সুউচ্চ দালান ও অট্টালিকা সবই শ্রমিকের অবদান। কোনো বিষয় অর্জন করার জন্য চেষ্টা করা, মেহনত-মুশাক্কাত বরদাশত করা ও মুজাহাদা করা সবই শ্রমের অন্তর্ভুক্ত।
এটা পার্থিব কোনো কাজ কিংবা প্রয়োজনেই হোক অথবা ধর্মের জন্যই হোক। পৃথিবীর বিভিন্ন বিদ্যা অর্জন করা, এ বিষয়ে গবেষণা করা এবং এগুলোকে শাস্ত্রীয় আকারে রূপ দেওয়া সবই শ্রমের ফল। সুতরাং পৃথিবীতে সবাই শ্রমিক। শ্রম ছাড়া কোনো কিছুই হয় না। সামান্যতম একটা কাজও করতে হলে নুন্যতম চেষ্টা বা নড়াচড়া হলেও করতে হয়। এটাই শ্রম। এজন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে শ্রমের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক। তিনি ইরশাদ করেন-
وأن ليس للإنسان إلا ما سعي-
মানুষ চেষ্টা বা শ্রম ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করতে পারে না। (সূরা নাজমঃ আ-৩৯)
والذين جاهدوا فينا لنهدينهم سبلنا-
যারা আমার জন্য চেষ্টা করবে, মেহনত করবে, আমি তাকে আমার রাস্তা দেখিয়ে দিবো।
(সূরা আনকাবুতঃ আ-৬৯)
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীসে ইরশাদ করেন-
أعطوا الأجير أجره قبل أن يجف عرقه- رواه ابن ماجه-
অর্থঃ শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও। (সুনানে ইবনে মাজাহঃ হা-২৪৪৩)
শ্রমের মূল্যায়ন করা এবং একে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া মানবিকতা। এর বিপরীতে কোনো মানবিকতা নেই। নবীজির উপরোক্ত বাণীতে এই কথাই ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দর ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় পুরো মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। আর তা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়; বরং তা সব সময়ের জন্য। তাই শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এই হাদীসের আলোকেই।

পৃথিবীতে শ্রম ও শ্রমিকের মূল্যায়ন নিয়ে শ্রমিকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অনেক আন্দোলন হয়েছে, পত্র-পত্রিকা ও সাময়ীকীতে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, কলাম ছাপানো হয়েছে, মতবিনিময় ও আলোচনা সভা হয়েছে, কিন্তু এতে কি শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? এছাড়া শ্রমের জন্য কত নীতিমালা করা হয়েছে, আইন সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু কাজের কিছুই হয়নি। এখনো অনেক শ্রমিক মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছে, শ্রম খাটতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে অথবা বিভিন্ন দূর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। অথচ এর প্রতিকার ও ক্ষতিপুরণ ওই সব ঘোষিত আইন-কানুনেই আটকে রয়েছে।
প্রতি মূহুর্তেই পৃথিবীতে শ্রম হচ্ছে। এর জন্য কেউ না কেউ খাটছে। মাথার ঘাম পায়ে ফালাচ্ছে। রাতের আধারে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, তখনও কল-কারখানায় অনেক শ্রমিক কাজ করে, প্রহরীরা বড় বড় স্থাপনা, শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বসবাসের ঘরবাড়ীতে নিরাপত্তার দায়িত্বে রাত জেগে পাহারা দেয়। সীমান্ত রক্ষীরা দেশের সীমানা পাহারা দেয়। মা তার ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে শিশু সন্তানকে কোলে রেখে সান্তনা দেয়। রোগীর শয্যাপাশে তার প্রিয়জনেরা রাত জেগে সেবা করে। চালকরা যানবাহন চালিয়ে মুসাফিরদেরকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। আকাশে বিমান উড়াল দিয়ে হাজারো মাইল পাড়ি দেয়। নদী-সমুদ্রের বুকে ভাসমান জাহাজে নাবিক নির্ঘুম রাত কাটায়। এভাবে আরো কত শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে অবদান রেখে চলেছে। যেনো পৃথিবীর প্রতিটি দিনই শ্রমিকের।

মে দিবসে শ্রম নিয়ে একটা আন্দোলন হয়েছে, যা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাই বলে ওটা মে দিবস হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিলো পৃথিবীতে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা। অত্যাচারী মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আর এটা হবে প্রতিদিনের জন্য। শুধু মে দিবসে নয়। ইসলাম শ্রমিকের যে মর্যাদা ঘোষণা দিয়েছে- তা শুধু নির্দিষ্ট কোনো দিনের জন্য নয়; বরং তা প্রতিদিনের জন্য।
শ্রম খাটার মধ্যে হীনমন্যতার কোনো অবকাশ নেই, হবেই বা কেনো; এটাতো মর্যাদার বিষয়। এ কারণেই নবীজি নিজে শ্রম খেটে এবং শ্রমিকের নায্য মজুরী আদায় করে উম্মাহকে শিখিয়ে গেছেন।
স্বয়ং তিনি এবং তাঁর প্রিয় সাহাবীরাও নিজে শ্রম খেটেছেন। তাঁরা কি করেননি? নবীজি কী করেছেন, দেখুন- তিনি নিজ হাতে ঘর ঝাড়– দিতেন। নিজ হাতে কাপড়ও সেলাই করেছেন। অথচ তিনি দো জাহানের সরদার। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর চেয়ে দামী এবং তাঁর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আর কেউ নেই। অন্য কেউ হবেও না। এছাড়া তিনি ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব নিজ হাতেই বাস্তবায়ন করতেন। তদারকি, প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ সবই তিনি নিজে করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রের এমনকি যুদ্ধের মতো স্পর্শকাতর ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগও তিনি নিজে পরিচালনা করেছেন। এভাবেই তিনি শ্রমকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শ্রমিকের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি এমন এক মূলনীতি প্রণয়ন করেছেন যে, এই এক মূলনীতির ভিতরে শ্রমিকের সব অধিকার এসে গেছে। কোনো ধরণের ফাঁক-ফোকড় বা নীতি বহির্ভুত কার্যকালাপের সুযোগ নেই। বাস্তবেই বিশ্বের ইতিহাসে যা একেবারেই বিরল। উপরোক্ত হাদীসে এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা ও তার স্বীকৃতিকে প্রতিদিনই কার্যকারিতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। ঘোষণা করতে হবে- শ্রমিক দিবস শুধু মে দিবসে নয়; শ্রমিক দিবস হবে প্রতিদিন।