শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে
বিশ্বব্যাপী একই দিনে বা একই তারিখে রোযা ও ঈদ করাকে ফরয/জরুরি সাব্যস্ত করার শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সামনে রাখতে হবে :
১. যে বিষয় গোড়া থেকেই সম্ভব নয় বা যে বিষয় পালনে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়, শরীয়ত কখনো এমন বিষয়ের আদেশ করে না। এজন্য যে কোনো সমঝদার ব্যক্তির কাছে প্রথম ধাপেই এই ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা শরীয়তের নির্দেশ হতেই পারে না। অসম্ভব অথবা প্রায় অসম্ভব কোনো কাজের আদেশ শরীয়ত করতে পারে না।
২. শরীয়ত নাযিলের সময় যে বিষয়ের কোনোও ধারণা-কল্পনাও ছিল না, এরকম বিষয় শরীয়তের নির্দেশ হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। সুতরাং এখানে তো একথা পরিষ্কার যে, এই কাজ শরীয়তের নির্দেশ হতে পারে না।
৩. নব উদ্ভাবিত কোনো কাজকে ফরয-ওয়াজিব তো দূরের কথা; সুন্নতের মর্তবাও যদি দেওয়া হয় তাহলেও এটা বিদআত হয়ে যায়। আর বিদআত তো গোমরাহী আর ভ্রষ্টতা।
৪. যে কাজের বিশেষ কোনো সওয়াব বা ফযীলত কুরআন হাদীসে বর্ণিত হয়নি আবার এই কাজ করতে গেলে অনেক কষ্ট ও অসুবিধা দেখা দেয় এরকম কাজ তো নিঃসন্দেহে ‘তাকাল্লুফ’ তথা লৌকিকতা ও নিরর্থক আয়োজন ছাড়া কিছু নয়। আর এ উম্মতকে এসব তাকাল্লুফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে- نهينا عن التكلف আমাদেরকে তাকাল্লুফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।
৫. বিশ্বব্যাপী এই ঐক্যের শরয়ী কোনো মানদণ্ড নেই। এটা যদি শরীয়তে নির্দেশিত হতই, তাহলে শরীয়তে এর কোনো মানদণ্ডও থাকত। এই প্রসঙ্গে যে তিনটি মানদণ্ড বলা হয়, এর একটাও আমলযোগ্য নয়!
ক. জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডার
এতে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন হয়ে যায়। সুতরাং এটা সম্পূর্ণ না-জায়েয। শরীয়ত-নির্ধারিত ভিত্তি ‘হিলাল দেখা’ পরিবর্তন করার ইখতিয়ার কারো নেই। কেউ যদি পরিবর্তন করে দেয়ও, তাহলেও আহলে হক মুসলমানরা একে গ্রহণ করবে না। তাহলে ঐক্য কীভাবে হবে।
খ. প্রথম হিলাল দেখা
এটা এ জন্য মানদণ্ড হতে পারে না যে, প্রথমবার কোথায় হিলাল দৃষ্টিগোচর হয়, তা অনুসন্ধান করার হুকুম শরীয়ত দেয়নি। আর বাস্তবে দূর-দূরান্তের অঞ্চলের জন্য প্রথম হিলাল কোথায় কখন দেখা গিয়েছে তা অনুসন্ধান করা অনেক জটিল বিষয়। তারপরও যদি হিলাল সাব্যস্ত হয়েও যায়, তাহলেও সেটাকে বিশ্বব্যাপী কার্যকর করতে গেলে অনেক জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এজন্য এই পদ্ধতিও আমলযোগ্য নয়।
গ. সৌদি আরবের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানানো
সৌদিআরবের চাঁদ দেখার ভিত্তিতেও বিশ্বব্যাপী আমল করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো এক জায়গার হিলালকে সমগ্র বিশ্বের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া, শুধু এতটুকু নয় যে, তা দলীলবিহীন, বরং এটা দলীলবিরোধী। সুতরাং এই পদ্ধতিই আসলে গ্রহণ করা উচিত যে, প্রত্যেক অঞ্চলের বাসিন্দারা নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখা অনুসারে আমল করবে।

সুতরাং যেহেতু বিশ্বব্যাপী ঐক্যের শরয়ী কোনো মানদণ্ড নেই, তাহলে এটা শরীয়তে ফরয /ওয়াজিব বা সুন্নত তো দূরের কথা; অন্তত শরীয়তের কাম্যও হয় কীভাবে?
৬. শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতা হল এই। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিপন্থী কিছু লোক বিষয়টাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন এবং এর জন্য এমন এমন দলীল বের করেন, যেন কুরআন-হাদীসে সম্পূর্ণ সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা শুরু করা এবং একই দিনে ঈদ করার কথা বলা হয়েছে। তারা এটাও বলেন যে, ‘যেহেতু আগের যামানায় প্রচারমাধ্যম এত উন্নত ছিল না; যা এখন হয়েছে, সেজন্য আগের লোকেরা শরীয়তের ঐ ওয়াজিব বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাদের যদি সুযোগ হত তাহলে তারা অবশ্যই এটা বাস্তবায়ন করতেন।
এখন তো প্রচারমাধ্যম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত হয়েছে যে, পুরো বিশ্ব যেন একটি গ্রাম। এখন আমাদের কুরআন-হাদীসের সেই বিধান বাস্তবায়ন করতে বাধা কোথায়?’
সামনে আমরা সেই ভাইদের পেশকৃত দলীলের (বাস্তবে যেগুলো দলীল নয়) উপর পর্যালোচনা করতে চাই। যেন এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এরা কোনো দলীল ছাড়াই একটি নব উদ্ভাবিত বিষয়কে শরীয়তের আবশ্যকীয় বিধান সাব্যস্ত করতে লেগেছেন।
৭. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার অভিমত আর একই দিনে রোযা ও ঈদ জরুরি হওয়ার মতকে এক মনে করা।
তাদের বড় এক দুর্বলতা হল, তারা ফিকহ-ফতোয়ার কিছু কিতাবে দেখেছেন যে, হানাফী মাযহাবে, (বরং এক অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে শাফেয়ী মাযহাব ছাড়া অন্য তিন মাযহাবেও এবং এক বক্তব্য অনুযায়ী শাফেয়ী মাযহাবেও) উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। সুতরাং যদি অন্য কোনো এলাকা থেকে ‘তরীকে মুজিব’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও শরয়ী নিয়ম-সমর্থিত পদ্ধতিতে খবর পাওয়া যায় তাহলে সে অনুযায়ী আমল করা জরুরি। এখান থেকে তাঁরা এটা বুঝে নিয়েছেন যে, দেখ! সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার কথা তো ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমও বলে গিয়েছেন!!

এটা তাদের অসম্পূর্ণ বুঝের পরিণাম ছাড়া কিছুই নয়। প্রথম কথা তো হল, لاعبرة لاختلاف المطالع ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ এমন ব্যাপক ও নিঃশর্ত কথা তো কোনো ইমামই বলেননি। ফিকহের কিতাবের পরবর্তী মুসান্নিফগণের অনেকে এ ধরনের নিঃশর্ত কথা যদিও লিখেছেন, কিন্তু ইমামদের কেউই এরকম নিঃশর্ত কথা বলেননি। ইমাম আহমদ ছাড়া অন্য তিন ইমামের মাযহাবেই অগ্রগণ্য বক্তব্য, যার উপর অধিকাংশ ফকীহ ফতোয়া দিয়েছেন তা এই যে,‘কাছাকাছি অঞ্চলের ক্ষেত্রে তো এক জায়গার হিলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় হবে, কিন্তু দূরবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রে এক জায়গার হিলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য প্রযোজ্য নয়’। হানাফী মাযহাবেরই অনেক বড় বড় ফকীহ এটা বলেছেন। ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে এর বিপরীতে একটি শব্দও বর্ণিত হয়নি।
‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ জাতীয় বাক্য ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে পাওয়া যায়নি। আর হানাফী মাযহাবে জাহিরুর রিওয়ায়াহ মানে হল ঐসব মাসআলা, যা ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শাগরেদ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ছয় কিতাবে উল্লেখ আছে। আলহামদু লিল্লাহ ইমাম মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সব কিতাব এখন ছাপা আছে। এসব কিতাবের কোথাও لاعبرة لاختلاف المطالع ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ জাতীয় কোনো বাক্য পাওয়া যায়নি।
অবশ্য এই বাক্য ‘কানযুদ দাকায়েক’ সহ ফিকহে হানাফীর কিছু কিতাবে অবশ্যই এসেছে। কিন্তু এর যে অর্থ এখন উদ্ভাবন করা হয়েছে যে, পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা ফরয, এরকম কথা সেই মুসান্নিফদের কল্পনার আশেপাশেও আসেনি। এখানে সম্পূর্ণ নব উদ্ভাবিত একটি বিষয়কে এই বাক্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু এ কথা বলা যে, নিজ অঞ্চলের বাইরে থেকেও হিলাল সাব্যস্ত হওয়ার শরয়ী সাক্ষ্য যদি ‘তরীকে মুজিব’ এর মাধ্যমে এসে যায়, তবে সে অনুযায়ী আমল করা জরুরী। কিন্তু তাদের কেউ এ কথা বলেননি যে, ২৯ শা‘বান সন্ধ্যায় মুসলমানদের দায়িত্ব শুধু এটুকু নয় যে, নিজ নিজ এলাকায় হিলাল তালাশ করবে বরং তাদের উপর এটাও ফরয যে, সারা বিশ্বের কোনো এলাকায় আজ হিলাল দেখা গিয়েছে কি না তা সন্ধান করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই করতে হবে, হিলাল দেখা প্রমাণিত হলে তা সারা বিশ্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ কথা যদি কোনো একজন ফকীহও কোথাও লিখতেন, তাহলেও বলা যেত যে, যাক! একজন ফকীহ তো অন্তত এ কথা বলেছেন! কিন্তু চার মাযহাবের ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবের বিশাল ভাণ্ডারে কোনো নির্ভরযোগ্য ফকীহের কিতাব থেকে এরকম কথা ইনশাআল্লাহ দেখানো যাবে না! বরং এর বিপরীতে যে সকল আলিম لاعبرة لاختلاف المطالع বক্তব্যকে হানাফী মাযহাবের বা অন্য মাযহাবের অগ্রগণ্য সিদ্ধান্ত মনে করেছেন তাদেরকেই যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, সারা বিশ্বে নয়, বরং বড় কোনো অঞ্চল জুড়ে প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদের আয়োজন করার শরয়ী বিধান কী, তখন তারা সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন, এটা ওয়াজিব তো কখনোই নয় বরং শরীয়তে এটা কাম্য বিষয়ও নয়।
(এমদাদুল ফাতাওয়া খ. ২, পৃ. ১২৯)
তো আমরা বলছিলাম, তাদের বড় দুর্বলতা এই যে, তারা কয়েক বছর আগের উদ্ভাবিত একটি প্রস্তাবকে কয়েকশ বছর আগের ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এই ভুল ধারণার ভিত্তিতে যে لاعبرة لاختلاف المطالع বাক্যে একথাই বলা হয়েছে, অথচ বিষয়টি এমন নয়।
৯. কুরআন ও হাদীসে কি একই দিনে রোযা ও ঈদ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে?
তাদের এরচেয়েও বড় দুর্বলতা হল, তারা নবউদ্ভাবিত একটি প্রস্তাব, যার সূচনাই হয়েছে বেশি দিন হয়নি, তারা একে সরাসরি কুরআন-হাদীসের হুকুম সাব্যস্ত করছেন।৩[3] তারা বলছেন, কুরআন কারীমের আয়াত ২ : ১৮৫ -এ এবং -صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته শীর্ষক হাদীসে এই হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা শুরু করতে হবে, একই দিনে রোযা শেষ করে ঈদ করতে হবে।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন….
জানি না, তারা সাধারণ বুদ্ধিকে কেন একটু কাজে লাগান না। যদি কোনো হুকুম কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টভাবে এসে থাকে তাহলে সেটা আর নতুন কথা হবে কীভাবে? এটা তো তাহলে আয়াত যখন নাযিল হয়েছে, হাদীস যখন ইরশাদ হয়েছে তখন থেকে মানুষের মাঝে একটা জানাশোনা বিষয় হত। অনেক পুরোনো বিষয় হত। তাফসীরের কিতাবে, হাদীসের ব্যাখ্যার কিতাবে, ফিকহের কিতাবে এর আলোচনা হত। প্রত্যেক যুগের আলিম ও ফকীহগণের মুখে এর চর্চা হত। এমন কেন হল যে, পনেরো শতকে এসে এটা আবিষ্কার করতে হল আর দলীল-প্রমাণের খোঁজে নামা হল।
যাই হোক, এখানে মনে হচ্ছে উক্ত আয়াত এবং উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা পূর্বাপরসহ উল্লেখ করে দিই। যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই আয়াত এবং এই হাদীসকে আলোচ্য বিষয়বস্তুতে টেনে আনা আয়াত ও হাদীসের উপর কত বড় জুলুম।
চলবে ….