রমযানের মতো মহিমান্বিত মাসের প্রতিটি মুহুর্ত এবং রমযানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আমলের মর্তবা ও ফযীলতও অপরিসীম। এ মাসে এমন কিছু আমল ও মুহুর্ত রয়েছে- যা দয়াময় আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি অপূর্ব দয়া-মায়া কিংবা অফুরন্ত ভালোবাসার নিদর্শন বটে। এ আমলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে পার্থিব জগতের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র হয়ে আখিরাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেন। আবার এর বদৌলতে অসংখ্য নেকি অর্জনের সৌভাগ্যও দান করে থাকেন।
মহাদানশীল পরম করূণাময় আল্লাহ তা’আলার দেওয়া নিয়ামত ও রিযিক ভোগ করে আখিরাতের পাথেয় গ্রহণের এমন সুবর্ণ সুযোগ আল্লাহ তা’আলাই দিতে পারেন। কারণ তাঁর চেয়ে মহান বাদশাহ কিংবা দয়াময় মনিব দ্বিতীয়টি কেউ নেই; আর হতেও পারবে না।

মধ্যরাতে সুবহে সাদিকের আগ মুহুর্তে কিছু খেয়ে আল্লাহ তা’আলার মুমিন বান্দাগণ যে সিয়াম শুরু করেন, তাকে সাহরি বলে। কত মহান আল্লাহ তা’আলা! আল্লাহু আকবার!! স্বীয় বান্দাগণের এ সাহরি খাওয়ার মধ্যেও তিনি নেকি দান করেন। হাদীসের ভাষায় একে বরকতের আহার বলা হয়েছে।
সাহাবি আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
تسحّروا، فإن في السحور بركة-
তোমরা সাহরি খাও; নিশ্চয়ই সাহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে।
(সহীহ মুসলিমঃ হা-১০৯৫; সহিহ বুখারিঃ হা-১৯২৩)
এ হাদীসের আলোকে সাহরি খাওয়া মুসতাহাব বলে প্রমাণিত হয়। বান্দার সুবিধার্থেই এ সাহরি খাওয়াকে আবশ্যক করা হয়নি। অন্যথায় নিদ্রার গভীরতার ফলে অনেকেই সাহরি খাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষতির শিকার হতে পারতো। এ জন্য সাহরি খাওয়াকে একদিকে অসংখ্য সাওয়াব ও বরকতের কারণ বলা হয়েছে; অপরদিকে কোনো কারণে কেউ সাহরি খেতে না পারলে তার সিয়াম আদায় হয়ে যাবে। অর্থাৎ এ কারণে সিয়ামের কোনো ক্ষতি হবে না। এভাবেই বান্দার সবদিক লক্ষ্য রেখে শরীয়তের বিধান কার্যকর করা হয়েছে। একদিকে সাওয়াব ও বরকত অর্জন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে; আবার ক্ষতির শিকার হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাই সিয়ামদারের জন্য সাহরি করা সুন্নাত। সাহরির শেষ সময় সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত। বিশেষ কিছু না পেলেও সাধারণ খাবার অথবা সামান্য পানি পান করলেও সাহরির সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। অপারগতাবশত কোনো কারণে সাহরি খেতে না পারলেও সিয়াম হয়ে যাবে; এ কারণে সিয়াম ছাড়া যাবে না।
অপরদিকে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে কোনো কিছু খেয়ে সিয়াম শেষ করাকে ইফতার বলে। সাহরির মতো ইফতারি করার মধ্যে অসংখ্য সাওয়াব ও ফযীলত রয়েছে। হাদীসে নববীর বর্ণনামতে খাবার সামনে নিয়ে ইফাতারির অপেক্ষার মুহুর্তে আল্লাহ তা’আলা ফিরিশতাদের সামনে তাঁর সিয়াম পালনকারী বান্দাগণের ব্যাপারে গর্ব করতে থাকেন। এ জন্য খুরমা কিংবা খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নাত। তা না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। বিনা কারণে ইফতারিতে দেরি করা ঠিক নয়।
ইফতারের কিছুক্ষণ আগে নিম্নোক্ত দো’আ বেশি বেশি পড়বে-
يَا وَاسِعَ الْفَضْلِ اِغْفِرْلِيْ-
অর্থঃ হে মহাক্ষমাশীল! আমাকে ক্ষমা করুন। (শু’আবুল ঈমান- ইমাম বায়হাকিঃ ৩/৪০৭)

এরপর এই দো’আ পড়ে ইফতার শুরু করবে-
اَللّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَعَلي رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ-
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আপনারই জন্য সিয়াম রেখেছি। আপনারই ওপর ঈমান এনেছি এবং আপনারই ওপর ভরসা করেছি। আর আপনারই দেওয়া রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।
(সুনানে আবি দাউদঃ হা-২৩৫৮)
তাছাড়া সহিহ সনদে সুনানে আবি দাউদের আগের বর্ণনায় এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারি শেষে এই দোয়া পড়তেন-

ذهب الظمأ وابتلّت العروق و ثبت الأجر إن شاء الله-
অর্থঃ পিপাসা বিদূরীত হলো, শিরা-ইপশিরা সজীব হলো এবং আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছায় সাওয়াব অর্জিত হলো।
(সুনানে আবি দাউদঃ হা-২৩৫৭)
ইফতারির দাওয়াত খেলে মেজবানের উদ্দেশ্যে এই দো’আ পড়বে-
أَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُوْنَ- أَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ- وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلَائِكَةُ-
অর্থঃ আপনার বাড়িতে যেনো সিয়ামদারগণ ইফতার করেন এবং নেক লোকেরা যেনো আপনার খাবার খান। আর ফিরিশতাগণ যেনো আপনার ওপর রহমতের দো’আ করেন।
(আস-সুনানুল কুবরা লিন-নাসাঈঃ ৬/৮১; ইবনুস সুন্নীঃ হা-৪৩৩)
এছাড়া কোনো সিয়ামদারকে ইফতারি করানো অনেক বড় ফযীলতের কাজ। সিয়াম ও ইফতারি সম্পর্কে হাদীসে সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। যথা- সাহাবী সালমান ফারেসী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদেরকে ইরশাদ করেন-

এ রমযান মাস ধৈর্য্য ধারণ করার মাস এবং এই ধৈর্য্য ধারণের বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত রেখেছেন। এ মাস মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার মাস। এ মাসে মুমিন লোকের রিযিক বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি কোনো সিয়াম আদায়কারীকে ইফতারি করাবে, এটা তার জন্য মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের কারণ হবে এবং সে উক্ত সিয়াম আদায়কারীর সাওয়াবের সমপরিমাণ সাওয়াব অর্জন করবে অথচ এ কারণে উক্ত সিয়াম আদায়কারীর সাওয়াব বিন্দু পরিমাণও কমবে না।
সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন- আমাদের অনেকেরই তো এমন সামর্থ নেই যে, কাউকে ইফতারি করাবো? নবীজি বললেন- কাউকে ইফতারি করানোর জন্য পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজন নেই। এক টুকরা খেজুর দিয়ে ইফতারি করালেও সে উক্ত সাওয়াবের অধিকারী হবে।
সাহাবি সালমান ফারেসি রাযি. বলেন, তিনি আরো ইরশাদ করেছেন-
যে ব্যক্তি এই রমযান মাসে কোনো সিয়াম আদায়কারীকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তা’আলা তাকে কিয়ামতের দিবসে আমার হাইযে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যা পান করার পর জান্নাতে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না।
(সহীহ ইবনে খুযাইমাহ- (এটা দীর্ঘ একটি হাদীসের কিছু অংশ); শু’আবুল ঈমান- ইমাম বায়হাকি)
সর্বোপরি রমযান ও সিয়াম সাধনা হলো তাকওয়াপূর্ণ জীবন যাপন করার জন্য বিশেষ এক প্রশিক্ষণ। এ সিয়াম সাধনা একদিকে উন্নত সমৃদ্ধ চরিত্রনির্ভর জীবন গঠনে যেমন ভূমিকা রাখে, ঠিক তেমনি সহানুভূতিশীল সমাজ গঠনে সিয়াম সাধনা বিরল একটি দৃষ্টান্ত। এ জন্যই রমযান মাসে সিয়াম সাধনার বিভিন্ন আমলেরও ফযীলত অভাবনীয়। সাহরি ও ইফতারি হচ্ছে এরই দুটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন।