পৃথিবীতে দিন ও সময়ের হিসাবের জন্য বর্ষভিত্তিক কয়েকটি সনের হিসাব প্রচলিত রয়েছে। তবে এর মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ হচ্ছে ঈসায়ী সন ও হিজরী সন। তবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতার তারতম্যের কারণে বিভিন্ন দেশে বা অঞ্চলে তাদের নিজস্ব বর্ষ গণনার পদ্ধতি চালু রয়েছে। যথা- পারস্য, চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া ইত্যাদি দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজস্ব বর্ষ গণনা রয়েছে।
ঈসায়ী সনের গণনা হয় সূর্যকে কেন্দ্র করে। ঈসায়ী বর্ষকে সৌরবর্ষও বলা হয়। পুরো পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সময় এই সৌরবর্ষ কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানের জন্য বিশ্বের সবাইকে সৌরবর্ষের হিসাব অনুসরণ করতে হয়। সৌরবর্ষের গণনার এই হিসাব ইংরেজী ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসন পরিচালিত হয় ইংরেজী ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে।
অপরদিকে হিজরী সনের গণনা হয় চাঁদের হিসাব অনুযায়ী। আর হিজরী সনের সম্পর্ক চাঁদকেন্দ্রিক আরবী মাসগুলোর সাথে হওয়ার কারণে একে চন্দ্রবর্ষও বলে নামকরণ করা হয়। ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, বিধি-বিধান ও ইবাদাতের সম্পর্ক চাঁদের সাথে। চাঁদের হিসাব ছাড়া যেগুলো কখনোই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। চাঁদকেন্দ্রিক বর্ষের বিভিন্ন মাসে কিছু আমল আছে- যেগুলোর গুরুত্ব ও ফযীলত কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যথা- আশুরা, শবে বরাআত, শবে কদর, রোযা, তারাবীহ, রমযানের ইতিকাফ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, কুরবানী ও হজ্জ ইত্যাদি ইবাদাতগুলো চাঁদ কেন্দ্রিক হিজরী সনের মাসের হিসাব অনুযায়ী সংঘটিত হয়। এছাড়াও নারীর ঋতুস্রাবের হিসাব, বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দতের সময়সীমা এবং মানুষের বালেগ হওয়ার চূড়ান্ত হিসাব চন্দ্রমাস অনুযায়ী নির্ণিত হয়।
এ কারণে ইসলামে হিজরী বর্ষের গণনা ও এর হিসাব রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। চন্দ্রবর্ষকে বাদ দিলে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বছরজুড়ে বিভিন্ন ইবাদাত ও হুকুম পালনে চরম বিপর্যয় ও মারাত্মক বিশৃংখলা দেখা দিবে।
অথচ এই হিজরী সন বা চন্দ্রবর্ষ সম্পর্কে মুসলমানদের মাঝে চরম উদাসীনতা এবং বিভিন্ন ভুল ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও বিধি-বিধান সাথে চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ইসলামে ও মুসলমানদের কাছে এই হিজরী সনের এবং এর মাসের হিসাব চালু থাকা অথবা কার্যকর হওয়া স্বাভাবিকতার দাবী। কিন্তু আরব বিশ্বে এই হিসাব কার্যকর থাকলেও আমাদের এই অঞ্চলে এবং আমাদের জীবনে হিজরী সনের হিসাব প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। শুধুমাত্র বিবাহ-শাদী ও ধর্মীয় কিছু ক্ষেত্রে আমরা হিজরী সনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। চন্দ্রমাসের এই হিসাবকে আমরা অবলীলায় অবহেলা করে চলেছি। মুসলমান হয়েও প্রিয় নবীজির উম্মত হয়েও জীবনের সর্বক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণা ও চাল-চলনকে গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা নামধারী মুসলমানে পরিণত হয়েছি। আরেকজনেরটা নিয়ে মাতামাতি করা কি উদারতা, না স্বীয় ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দেওয়া- তা বুঝতে আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। বিষয়টা এতো জটিল আকার ধারণ করেছে যে, এক্ষেত্রে ইসলাম নিয়ে কথা আসলে অযথা তর্ক-বিতর্ক ও বিবাদে জড়িয়ে পড়ছি।
সুতরাং আমাদের জীবনে হিজরী সনের হিসাবের গুরুত্ব থাকা উচিত। আমরাই যদি এ হিসাবকে এড়িয়ে চলি, হিজরী সনকে ভুলে যাই- তাহলে এ হিজরী সনের হিসাব রাখার জন্য পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কোনো জাতি আছে কী? বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।