মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বেই। কয়েকটা দেশই মাত্র বাকী, যেখানে এখনও করোনা ছড়ায়নি। করোনার কারণে স্থবির হয়ে আছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানুষের মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এড়াতে ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে ধর্মীয় অনেক প্রোগ্রাম। প্রায় সমগ্র বিশ্বেই মসজিদে জুমা-জামাত সীমিত রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে ঘনিয়ে আসছে ইসলামের অন্যতম ইবাদত হজ্বের সময়। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ হজ্ব আদায়ের জন্য মক্কায় সফর করেন। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সৌদি আরবেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকায় এবারের হজ অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে এবার বাতিল হতে পারে হজ। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সতর্কতার জন্য হজ ও ওমরাহর ভিসা স্থগিত করা হয়। এমনকি পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে তাওয়াফ স্থগিত করা হয়েছে।

হজ্ব যদি এ বছর শেষ পর্যন্ত না হয় তবে এটা হবে গত দেড়শত বছরের মধ্যে হজ্ব বাতিল হওয়ার প্রথম ঘটনা। ইতিহাসে হজ বাতিলের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে আধুনিক ইতিহাসে এটা বিরল। মার্চ মাসের শুরুতেই কাবা চত্বর করোনাভাইরাসের জীবাণুমুক্ত করার জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই বলে এ নিয়ে ইসলাম শেষ হয়ে গেল, কিয়ামত এসে পড়ল বলে হা-হুতাশ করার কিছু নেই। অবশ্য এর আগেও যুদ্ধ বিগ্রহ,মহামারীসহ নানা কারণে একাধিকবার হজ্ব বাতিল করা হয়েছিল। হজ ও কাবা বন্ধ হওয়ার ঘটনা আগেও অনেকবার ঘটেছে। এবছর যদি মহামারিজনিত কারণে সৌদি সরকার হজ্জ্ব বাতিল করেন সেটির জন্যে অশনি সংকেত ভাবার কোন কারণ নেই। রোজা না রাখার যেমন শর্ত হজ্জ্ব না করারও শর্ত আছে।
নবম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার পর থেকে ইসলামের ইতিহাসে নানা সময়ে হজ-ওমরাহ বন্ধ ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মহামারির প্রাদুর্ভাব, বৈরী আবহাওয়াসহ নানা কারণে অনেকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
মক্কা অবরোধ ও আক্রমণ
আবরাহার আক্রমণ- হস্তিবর্ষে আবরাহার আক্রমণের ফলে পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে হজ ও তাওয়াফ বন্ধ থাকে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ভেতর ঘটনাটি ঘটেছে। এ বছরই রাসুল (সা.) জম্মগ্রহণ করেছিলেন। কাবা ধ্বংস করে মানুষকে ইয়েমেনে নিতে চেয়েছিল আবরাহা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা কাবা রক্ষা করেছিলেন। এ সময়ও কাবায় তাওয়াফ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে।
প্রথম মক্কা অবরোধ (৬৮৩ সাল) ও দ্বিতীয় মক্কা অবরোধে (৬৯২ সাল) কাবা ঘর একবার আগুনে আরেকবার পাথরের আঘাতে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সম্পূর্ণ নতুন করে কাবাঘর নির্মাণ করতে হয়েছিল।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আক্রমণ- ৭৩ হিজরি ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের নির্দেশনায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কাবা অবরোধ করে। সেখানে আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রা.) আত্মগোপন করেছিলেন। খলিফার পক্ষে বাইআত না করে তিনি নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এভাবে ৯ বছর অতিবাহিত হয়। এই সময়ে আক্রমণের কারণে কাবার বিভিন্ন দিক ধ্বংস হয় এবং নামাজ ও ওমরাহ বন্ধ থাকে। এমনকি আবদুল মালিক বিন মারওয়ান বিজয়ী হলে আবদুল্লাহ বিন জুবায়েরের নির্মিত অংশটুকুও ভেঙে ফেলা হয়। ফলে কাবা পুনর্নির্মাণের সময় নামাজ ও তাওয়াফ বন্ধ থাকে।
আব্বাসীয় খেলাফতের যুগে- ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয়দের সময় ইসমাঈল বিন ইউসুফের মক্কা আক্রমণের কারণে হজ বাতিল হয়েছিল।
ফরাসিদের আক্রমণ- ১২১৩ হিজরিতে ফরাসিদের আক্রমণের ফলে নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে হজও বন্ধ থাকে।
অতঃপর ১৯৭৯ সনে আবারও কাবাঘর আক্রমণের শিকার হয়। এ সময় জুহাইমান আল ওতাইবি ও সঙ্গীরা কাবা আক্রমণ করে।

হজ কাফেলার ওপর আক্রমণ
হজ্ব বাতিলের প্রথম ঘটনা ঘটে ৯৩০ হিজরিতে। হাজীদের উপর হামলার জেরে ১০ বছর পর্যন্ত হজ্ব বন্ধ থাকে। এটি ছিল মুসলিমদের বেদনাদায়ক ইতিহাস। আব্বাসী খেলাফত আমলে সেবছর হজ্ব চলাকালে বাতিল ফেরকায় বিশ্বাসী বাহরাইনের শাসক আবু তাহের কারামিয়া নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী সর্ববৃহৎ হাজিদের কাফেলায় আক্রমণ করে। অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করে এবং তাদের সম্পদ ছিনতাই করে। ইরাক ও সিরিয়া থেকে মক্কা আসার পথে তারা আতঙ্ক তৈরি করে। ফলে ৩১৭ হিজরি থেকে ৩২৭ হিজরি পর্যন্ত হজের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
(তারিখুল ইসলাম- ইমাম জাহাবি, ২৩/৩৭৪)
মক্কায় শিয়াদের আক্রমণ
এরপর হজ বন্ধ হয়েছিল ৯৩০ সালে। কট্টর শিয়া গ্রুপ কারমাতিদের আক্রমণে সে বছর ৩০ হাজার হাজি শহীদ হয়।
শিয়াদের একটি দল হলো কারামিয়া। ইরাকের আব্বাসি শাসক ও মিসরে উবায়াদি শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে আরব উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে বাহরাইনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তাদের বিশ্বাস ছিল,‘হজ জাহেলি যুগের একটি নিদর্শন। হজ মূর্তির উপাসনার মতো।’ তাই ইসলামের ফরজ বিধান হজ বন্ধ করতে কারামিয়া শাসকরা তৎপর হয়ে ওঠে। মূলত ইসলামের ইতিহাসে হজ ফরজ হওয়ার পর কারামিয়ারা সর্বপ্রথম কাবায় আক্রমণ করে হাজিদের হত্যা করে।
বাহরাইনের শিয়া রাজা কারমাতিয়ান ৮ই জিলহজ কাবা শরীফ আক্রমন করেন। গিলাফ পুড়িয়ে দেন। কুড়াল দিয়ে ভেঙে হাজরে আসওয়াদ নিয়ে যান হফুফের জাওয়াথা মসজিদে। ত্রিশ হাজার হাজিকে হত্যা করেন। লাশ ফেলে কাবার ঘরের উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, কই আবাবিল, কোথায় তোরা পারলে মার আমাকে পাথর দিয়ে।
তারা হাজিদের হত্যা করে মরদেহ জমজম কূপে ফেলে দিয়ে জমজম বন্ধ করে দেয়। ফিরে যাওয়ার সময় হাজরে আসওয়াদ বাহরাইনে নিয়ে যায়। সেই সময় দশ বছর হজ্জ্ব বন্ধ ছিল। হজ্জ্ব চালু হলেও হাজরে আসওয়াদ ফিরেছিল প্রায় ২৬ বছর পরে।
কারমাতিয়ান রাজার মৃত্যু হয়েছিল মাংস খসে খসে পঁচে যেভাবে আবাবিলের বা পাখির ঝাকের পাথরে আব্রাহার সেনাদের মৃত্যু হয়েছিলো। আবাবিল কোন পাখি নয়, আরবীতে পাখির ঝাঁককে আবাবিল বলে।
শিয়া সংঘাতের সর্বশেষ ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই। একদল ইরানি হাজি কাবা চত্বরে ইসরায়েল-আমেরিকা বিরোধী বিক্ষোভ করলে সৌদি পুলিশ আর ন্যাশনাল গার্ড তাতে বাধা দেয়। এরপর সংঘর্ষে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তখন কাবার তাওয়াফ বন্ধ করা হয়। এর আগে ১৯৭৯ (২০ নভেম্বর) সালে জুহাইমান আল ওতাইবি তার এক শিষ্যকে ইমাম মাহদি দাবি করে কাবা ঘর দখল করে নেয়। সে সময় প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত কাবা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ ছিল। কোনো তাওয়াফ অনুষ্ঠিত হয়নি।
রাজনৈতিক কারণ
ইতিহাসে এটাও দেখা গেছে, রাজনৈতিক সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সময় বর্হিবিশ্বের হাজিরা কিংবা নির্দিষ্ট দেশের হাজিরা হজপালনে আসেননি। রাজনৈতিক কারণে সর্বশেষ ২০১৬ সালে ইরান তাদের কোনো নাগরিককে হজপালনের জন্য সৌদি আরব পাঠায়নি।
সংঘাত ও দ্বন্দ- ৩৭২ হিজরিতে আব্বাসি খলিফা ও মিসরের উবাইদি শাসনের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়। ফলে ৩৭২ থেকে ৩৮০ হিজরি পর্যন্ত ইরাকের কেউ হজ করতে পারেনি।
৯৮৩ থেকে ৯৯০ সাল পর্যন্ত হজ বাতিল হয়েছিল রাজনীতির কারণে। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আব্বাসীয় খিলাফত এবং মিসরভিত্তিক ফাতেমীয় খিলাফতের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে সেবার টানা ৮ বছর হজ বন্ধ ছিল।
১০০০ খ্রিস্টাব্দে ব্যয় মেটাতে অক্ষম হওয়ায় প্রায় ২৯ বছর মিসর, ইরাক, মধ্য এশিয়া ও উত্তর আরব অঞ্চলের কোনো হজযাত্রী হজপালনে আসেননি। ১০৩০ সালে কয়েকজন ইরাকি হজযাত্রী হজপালনের জন্য মক্কায় আসেন। অর্থনৈতিক কারণের তুলনায় এ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ হজপালনে আসেননি।

নিরাপত্তাহীনতা- ৪৯২ হিজরিতে মুসলিম বিশ্বের শাসকদের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে ব্যাপক সংঘাত দেখা দেয়। এতে মক্কায় গমনের পথ অনিরাপদ হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাস খ্রিস্টানদের দখলে যাওয়ার পাঁচ বছর আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
একইভাবে যুদ্ধের কারণে মুসলিম বিশ্বজুড়ে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে কেউ ১০৯৯ সালে হজ করেননি।
হালাকু খানের বাগদাদ অবরোধ- কাবায় তাওয়াফ বন্ধ হয়েছিল ১২৫৮ সালে। সেবার বাগদাদ অবরোধ করে হালাকু খান। অবরোধ বেশ লম্বা ছিল। ভয়ে মানুষ বের হয়নি। সেবার উমরা ও হজ বন্ধ করা হয়। হালাকু খান শুধু বাগদাদে দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল।
মহামারি রোগের বিস্তার
শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, মহামারির কারণেও হজ বাতিল হয়েছিল।
মাশিরি নামক মহামারি- প্রথমে ৩৫৭ হিজরিতে মক্কায় মাশিরি নামের একটি রোগ মহামারি আকারে দেখা দেয়। এ সময় হাজিদের বেশির ভাগ লোকই মৃত্যুবরণ করে। কেউ কেউ মক্কায় আসার পথে পিপাসায় কাতর হয়ে মারা যায়। আর অনেকে হজ সম্পন্ন করে মারা যায়।
মক্কায় দ্বিতীয় দফায় মহামরি- বাহরাইনের শিয়া রাজার আক্রমণের ৩৮ বছর পর ৯৬৮ হিজরিতে প্লেগের কারণে হজ্ব বন্ধ রাখা হয়। ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় মহামারী দেখা দিলে হজ্জ্ব বন্ধ ছিলো সেবার। ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে বলা হয়েছে, ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় একটি রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ সময় মক্কায় হজযাত্রীদের ব্যবহৃত উটগুলো পানির অভাবে মারা যায়। সেবারও হজ বন্ধ ছিল।
এর পর প্রায় ১০৩০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণে সে অঞ্চলের মানুষের হজ্বের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

হেজাজ প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া অজ্ঞাত প্লেগ- অতঃপর ১৮১৪ সালে হেজাজ প্রদেশে প্লেগের কারণে ৮ হাজার মানুষ মারা যাওয়ায় হজ বাতিল করা হয়। এরপর ১৮৩১ সালে ভারত থেকে যাওয়া হজযাত্রীদের মাধ্যমে মক্কায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং চারভাগের তিনভাগ হাজি মৃত্যুবরণ করে। ফলে সে বছর হজ বাতিল করা হয়। এছাড়া ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে প্লেগ এবং কলেরার কারণে তিন বারে মোট ৭ বছর হজ বন্ধ ছিল।
ভারতে ছড়িয়ে পড়া কলেরা রোগ- এরপর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রকাশ পাওয়া কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তিন-চতুর্থাংশ হাজি মারা যায়। এ ছাড়া আরো কিছু মহামারির প্রকাশ ঘটে। ফলে ১৮৩৭ থেকে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘদিন মক্কায় হাজিদের আগমন বন্ধ ছিল।
মুসলিমদের গৃহযুদ্ধ ও খ্রীষ্টানদের সঙ্গে সংঘাত
১০৯৯ এবং ১১০০ হিজরি সালে মুসলিম বিশ্বে গৃহযুদ্ধের কারণে হজ্ব বন্ধ থাকে। এসময় খ্রীষ্টানদের সাথেও মুসলিমদের তুমুল যুদ্ধ হয়। তখন ২০০ বছর ধরে কয়েক দফায় হজ্ব বাতিল করা হয়।
কাবা ঘরের পুনর্নির্মাণ
এ ছাড়া নবুয়তের পাঁচ বছর আগে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কাবা ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে কোরাইশরা কাবা পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর তখনো কাবায় তাওয়াফ বন্ধ থাকতে পারে। যেহেতু তাতে দীর্ঘ সময় লেগে ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের ঘটনা এ সময় ঘটেছিল।
বৃষ্টি ও বন্যার অবনতি
৪১৭ হিজরিতে মিসর ও প্রাচ্যের কারো পক্ষে হজ করা সম্ভব হয়নি। ৪২১ হিজরিতে ইরাক ছাড়া অন্যরা হজ করতে পারেনি। ৪৩০ হিজরিতে ইরাক, খোরাসান, শাম ও মিসরের কেউ হজ করতে পারেনি। কারণ এ সময় দোজলা নদীসহ অন্যান্য বড় নদীর পানি বরফ আবৃত হয়। ফলে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। (ইবনুল জাওজি, আল মুনতাজাম, ৯/১৬৬)
১০৩৮ হিজরি ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় ব্যাপক বন্যা হয়। ফলে কাবার দেয়াল ভেঙে পড়ে। সুলতান চতুর্থ মুরাদের নির্দেশে কাবা পুনর্নির্মাণের সময় হজ ও ওমরাহর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে, এটি ছিল কাবার সর্বশেষ নির্মাণ।

এরপর ১৬২৯ সালে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয় মক্কায়। তখন কাবার দেয়াল ধসে যায়, বন্ধ হয় তাওয়াফ। বন্যা শেষে গ্রানাইট পাথরে নতুন করে কাবা বানানো হয়। উসমানি সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে তখন কাবা ঘর সুন্দর করে আবার বানানো হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই একই মূল গঠন আছে।
এই ভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা,মহামারির প্রাদুর্ভাব,বৈরী আবহাওয়াসহ নানা কারণে কারণে প্রায় চল্লিশ বার হজ্জ্ব হয়নি। কোন সময় কিছু দেশের মানুষ আসতে পারেনি, কোন সময় পুরো পৃথিবীর কেউ আসতে পারেনি। যে আল্লাহ হজ্জ্ব ফরজ করেছেন তাঁর ইচ্ছেতেই এগুলি হয়েছে। আরব নিউজে প্রকাশিত এই চিত্রে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন ইতিহাসে ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৩ পর্যন্ত সময়ে আরও কয়েকবার হজ্ব বন্ধ থাকার কথা জানা যায়। সর্বশেষ হজ্ব বন্ধ থাকে ১৮৮৩ সালে। এরপর থেকে গত দেড়শ বছরে একবারও হজ্ব বাতিল করা হয়নি। তবে বিস্ময়ের কথা হলো,গত শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী স্প্যানিজ ইনফ্লুয়েঞ্জার সময়ও হজ্ব আদায় বন্ধ করা হয়নি।

এবারও যদি হজ বন্ধ হয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, অতীতেও হজ বাতিল হয়েছিল। আর ইসলাম অবাস্তব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম মানুষের সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় না। সুতরাং মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলে বিজ্ঞ মুফতিরা হজ বাতিলের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। তাছাড়া এ বছর যদি শেষ পর্যন্ত হজ্ব বাতিল করা হয় তবে তা সহজে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সৌদি আলেমদের পক্ষ থেকে।
অবশ্য কিছুদিন আগে সউদি আরবের সরকার সীমিত কয়েকটি দেশের হাজিদের এ বছর হজ করার সুযোগ দেওয়ার ফরমান জারি করেছে। যার ফলে এবারে পুরোপুরি হজ বাতিল না হয়ে সীমিত আকারে তা পালন করার সুযোগ পাচ্ছেন নির্দিষ্ট কিছু ভাগ্যবান মুসলিম।
তথ্যসূত্র :
তারিখুল ইসলাম- আজ জাহাবি: ২৩/৩৭৪, আল মুনতাজাম- ইবনুল জাওজি: ৯/১৬৬, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ইবনে কাসির: ১১/১৪৫, আন নুজুম জাহেরা- ইবনে তাগরি বারদ: ৪/২৪৬, দারাতুল মালিক আবদুল আজিজ, আনাদোলু নিউজ এজেন্সি, আল খালিজ অনলাইন ডটনেট, দ্যা ডন উর্দু, মিডল ইস্ট আই, আরব নিউজ।